পবিত্র বাইবেলের মনোরম পৃষ্ঠার মতো, রামায়ণ ও মহাভারতের বেদনাময় ঐশ্বর্যের মতো, বিক্ষুব্ধ কখনোবা প্রশান্ত তরঙ্গিত অববাহিকার মতো আমাদের সামনে খুলে খুলে যায় বঙ্গবন্ধুর অলৌকিক মহাকাব্যিক মহাজীবন। তাঁর মহাবিদ্রোহী তেজোদীপ্ত ধ্যানময় ভাবনালোক এবং একজন সফল ও সার্থক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর প্রায়োগিক পরিকল্পনা- পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতিকে দিয়েছে হিমালয়ের চাইতে অনেক ঊর্ধ্ববাহী একটি আকাশছোঁয়া অধিষ্ঠান। বাংলাদেশ ও তার স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রিক অভিব্যঞ্জনার মহান রূপকার, জাতিপিতা তিনি, প্রতিটি বাঙালির দৃঢ়তায় সাহসে সংগ্রামে সারবান অস্তিত্বসত্তায় অভিমণ্ডিত তিনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)।
এই মহিমান্বিত মানুষটি তাঁর অভেদ্য শেকড়াঙ্কুর ও দুর্জয় উজ্জীবনা দিয়ে আমাদের একটি আধুনিক জাতিরাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালি জাতি যেভাবে নিপীড়নের নির্মম নিগ্রহে তাদের জীবনপ্রবাহ চালিয়ে এসেছিল, তাদের মাঝে পৌরাণিক কোনো মহাবীরের মতো যাকে প্রতিবিম্বিত হতে দেখি, তিনিই তো আমার সোনার বাংলার অবিসংবাদিত রাষ্ট্রনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এখানে বিস্ময়ের বিষয়টি হচ্ছে, বয়সের অনুপাতে বা কালিক ব্যবধানে মাত্র ৫৫ বছর ৪ মাস ২৯ দিনের একটি ক্ষীণায়ু জীবন তাঁর। এর মধ্যে প্রায় ১৪ বছর কাটিয়েছেন কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। তাছাড়া তাঁর মানস-গঠনপর্ব হিসেবে শৈশব-কৈশোরের ১৪ বা ১৫ বছর বাদ দিলে তাঁর মূল কর্মময় মহান জীবনটি হয় ২৫ বছরের কিছু বেশি। এই মাত্র ২৫ বছরের রজতরেখা-মণ্ডিত ক্ষণস্বী জীবৎকালে বাঙালি জাতির ২৫ শতাব্দীরও বেশি সময়ের একটি সর্বব্যাপী ঘোর অমানিশা ও নেতৃত্বহীন ইতিহাসকে, ইতিহাসের নিদ্রিত শিরা-উপশিরাকে তিনি ঝাঁকিয়ে দিয়েছেন। আমূল খোলনলচে বদলে দিয়েছেন অন্যায়-অত্যাচার ও নিপীড়নের সমূহ করালগ্রাসকে। তিনিই বাঙালি জাতিকে একটি ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তিকামী জনতার সমন্বয়ে গঠিত একাত্তরে, একটি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাল-সবুজের বিজয় পতাকা বা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। এখানে তাঁর যে ত্যাগ- তিতিক্ষা-সাধনা, তাঁর যে নিরাপস নেতৃত্ব, তাঁর যে অনন্য ও অভূতপূর্ব লৌহ-ইস্পাতি দৃঢ় মনোবল, রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা- সেসবের নিরঙ্কুশ সাফল্যগাথা তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট ও উৎকীর্ণ। এজন্যই তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক; তিনিই আমাদের যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির জাতিস্মর এক উদ্যতা প্রতীক, জাতির জনক এবং অভ্রংলিহ দিদিশারি।
২
পৃথিবীখ্যাত লেবানিজ কবি ও দার্শনিক কাহলিল জিবরান তাঁর ‘দ্য প্রফেট’ গ্রন্থটি শুরু করেন একটি জাহাজের বর্ণনা দিয়ে, যে জাহাজে করে আল মুস্তাফা নামী ঈশ্বরের একজন প্রিয়পাত্র, যিনি স্বকাল ও স্বজাতির জন্য ছিলেন নতুন দিনের উষার মতো, পাড়ি দেবেন সেই দ্বীপে, যেখানে তিনি জন্মেছিলেন। সেখানে তাকে অনেক দুঃখবেদনা, যন্ত্রণাদগ্ধ নৈঃসঙ্গ্য, স্মৃতি-বিস্মৃতি ও আশ্চর্য বায়ুতরঙ্গ প্রভৃতি মাড়িয়ে একা, একজন ঈগল হয়ে উড়ে যেতে হবে সূর্যকে অতিক্রম করে।
যখন তিনি জাহাজে উঠতে যাবেন, তখন ওরফালিস নগরীর পুতপবিত্র মন্দিরের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এল দৃষ্টিতে গভীর মমত্বমাখা এক রমণী, যার নাম অলমিত্রা, অসম্ভব ভবিষ্যৎ দেখতে পারার ক্ষমতা ছিল তার। সে আল মুস্তাফাকে সম্বোধন করে বলল, হে বিধাতার প্রেরিত পুরুষ, সবচাইতে দূরবর্তী ও পূর্ণতমের অন্বেষী। তুমি চলে যাওয়ার আগে এই নগরীর মানুষ আমরা, তোমার কাছে সবিনয়ে জানতে চাইছি যে, তুমি আমাদের কিছু বলো। আমাদের দিন ও রাত্রির যাপন, আমাদের জন্মমৃত্যুর মধ্যে যা আছে, আমাদের শস্য ও ফসলের মধ্যে যা কিছু তোমাকে দেখানো হয়েছে, তার সব কথা তুমি আমাদের বলো। সেদিন অলমিত্রার উত্তরে আল মুস্তাফা বলেছিলেন, ‘হে ওরফালিসের মানুষেরা, ঠিক এই মুহূর্তে তোমাদের আত্মার গভীরে যা উন্মথিত হচ্ছে, সে কথা ছাড়া আর কীইবা আমি তোমাদের বলতে পারি?’
এবং প্রতিউত্তরে আরও অনেক কথা বলেছিলেন তিনি, আমার কাছে সেসবের সারমর্মটি অনেকটা এরকম: এবার জেগেছে শতাব্দীর নিদ্রিত আত্মারা। তাদেরই প্রাণজ উচ্চারণ যেন ‘…আর দাবায়ে রাখতে পারবা না…।”…রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, তবুও এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ…।’ ‘…এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা…।’
প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ না হলেও একজন প্রত্যাশিত গডো বা পরিত্রাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির উদ্দেশে এমনই এক মহামুক্তির অনন্য আত্মগত দুর্মর বার্তাটি জানান দিয়েছিলেন তাঁর সেই সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। তাঁর এই অভিভাষণ বাঙালি জাতির মুক্তির মহাসনদ।
কী অপূর্ব ললিত ঝংকৃত উন্মথিত উদ্দাম ও অবিরাম প্রজ্ঞার ঝরনাধ্বনি তাঁর সেই শব্দরাশি ও বজ্রনির্ঘোষী দ্রোহী ঘোষণা- যেন এক মহাকাব্য। তাঁর সার্বভৌম তর্জনী, তাঁর সারাজীবনের অভিজ্ঞতার গৌরবান্বিত মর্মনির্যাসটি যেন তিনি ঢেলে দিয়েছেন এই উচ্চারণে। তাঁর এই মহাভাষণের মর্মবাণীটি প্রকৃতির ইথার থেকে ইথারে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে হতে মহাকালের অথই বিস্তারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি অন্তহীন স্বপ্নপূরণে, যেখানে তিনি পৃথিবীর এক চির অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহারাজাধিরাজ যেন! বাংলা ভাষায় এমন একটি ঐতিহাসিক ঐশী দেশনাঋদ্ধ অভিভাষণ পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতিকে করেছে গৌরবান্বিত।
৩
বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন বাঙালির ইতিহাসের আরেক যুগপৎ মর্মন্তুদ ও বিপ্লবী উপাখ্যান। অনবরত মিথ্যা মামলা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হয়রানির নিমিত্তে বারবার জেলে যাওয়া তাঁর মহান জীবনের নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর অপরাধ, তিনি এদেশের মানুষের অধিকারের পক্ষে কথা বলেন। তাঁর অপরাধ, তিনি বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখান, সংগঠিত করেন, যাবতীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায্যতার কথা বলেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর এসকল লৌহমানবতুল্য বজ্রকঠিন অবস্থান একটি ‘অমার্জনীয় অপরাধ’ বা একধরনের ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’। এজন্য সর্বাগ্রে তাঁকে থামাতে হবে। এজন্যেই তাঁকে বারবার জেলে পুরে রাখা।
একসময় এই কারাগার বা জেলখানাই হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সৃষ্টিশীলতার উর্বর ভূমি ও তুমুল আঁতুড়ঘর। এই কারা-অন্ধকারে বসেই তিনি নিজেকে ও নিজের জীবনকে অন্যতর এক মশালে প্রজ্জ্বলিত করে তোলেন। শব্দে চিন্তায় সৃজনোপলব্ধিতে নিজের নিঃসঙ্গ প্রহর ও সমূহ নৈঃশব্দ্যকে তিনি মূর্ত করে তোলেন। তাঁর মহান আত্মত্মজৈবনিক লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র প্রতিটি পৃষ্ঠা, প্রতিটি বর্ণনা, প্রতিটি চিত্রদৃশ্য যেন বাঙালি জাতির একটি শাশ্বত আয়না। চাইলেই যে-কেউ এই আয়নার প্রতিবিম্বে নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে পারেন।
এর ভাষা নিতান্ত সহজ, নিরাবরণ ও প্রাঞ্জল। এক আশ্চর্য মায়া এর প্রতিটি বাক্যে ও গাঁথুনিতে। বঙ্গবন্ধু এখানে নিজেকে, নিজের যাপিত রাজনৈতিক জীবন ও নানা সংঘাতপূর্ণ সময়কে খুলে খুলে দিয়েছেন আপন খেয়ালিতে ও তদাত ধ্যানস্থতায়। একজন খাঁটি বাঙালি মানুষ কীভাবে সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে ওঠেন, একজন ভাটিবাংলার নেতা কীভাবে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠেন, একজন হ্যামিলনের বাঁশিঅলা কীভাবে সার্বজনীন কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন, তার অনুভবের সারাৎসার রয়েছে এই বইয়ের প্রতিটি অক্ষরে, আশ্চর্য বর্ণমালায়।
বঙ্গবন্ধু রচিত আরও দুটি বই এখন আমাদের উজ্জ্বল বাতিঘর। ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’। এই বই দুটির ভাষাভঙ্গিও বড়ো বাঙালিয়ানামণ্ডিত। তাঁর মুখের বুলির জাদুমাখা রেশটি যেন এর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ও আশ্চর্য বাক-প্রতিমায়। সেখানে তাঁর দার্শনিক অভিব্যক্তি ও বক্তব্যের রসপ্রবাহী কৌতুকী ঢং বা শৈলীটি বাংলাদেশেরই প্রতিনিধিত্ব করে।
8
টুঙ্গিপাড়া থেকে জাতিসংঘ- যেখানেই বঙ্গবন্ধু পদার্পণ করেছেন, সেখানেই নিজস্বতার অভূতপূর্ব সাক্ষর উৎকীর্ণ করেছেন। টুঙ্গিপাড়ার নিসর্গপ্রকৃতি, এর আবহাওয়া, খালবিল-নদীনালা, মধুমতী ও ঘাঘরা নদীর তীর, হাওড়-বাওড়, গিমাডাঙ্গার মাঠঘাট, বনবাদাড়, এর সবুজ-শ্যামল উদার সৌন্দর্য তাঁকে দিয়েছে মুক্ত বিহঙ্গের উদ্দাম উল্লাস ও স্বাধীনচেতা মানুষের অবগাহন। এখানকার সোঁদা মাটির আবহে সিক্ত গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশা, সংকট-সমস্যা ও বঞ্চনা-হাহাকার সেই শৈশব-কৈশোরে তিনি খুব কাছ থেকেই উপলব্ধি করেছেন। তিনি সেই সময়েই যেকোনো অন্যায়-অনাচার, শোষণ-নিপীড়ন এবং জমিদারি, তালুকদারি ও মহাজনি প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেকে শানিত করেছেন। নিজের গ্রামের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষ মানুষের সম্মিলিত সামাজিক আবহে নিজের অসাম্প্রদায়িক চিত্তজগতকে দীক্ষিত করে তোলেন।
এভাবেই টুঙ্গিপাড়ার সেই দুরন্ত কিশোর ‘খোকা’ ওরফে শেখ মুজিবের অমিত সাহসী নামটি ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়, সারা বিশ্বে। তারপর ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে উপমহাদেশের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও বাঙালির ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় সংগ্রামী অকুতোভয় ও বলিষ্ঠ চেতনার পরিচয় আমরা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশ নামকরণের ইতিহাসটিও ইতিহাসের অমর হরফে খোদাই করা আছে।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে। সেখানে তিনি বলেন, “এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইতেছে। …একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। … জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে হইবে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।
বাঙালি জাতির আরেকটি ঐতিহাসিক অর্জন, বিশ্বদরবারে তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার বীরত্বপূর্ণ সম্মান ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করতে হয়। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করেন। সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা প্রদান করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে, নিজের বলিষ্ঠ, পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিচয়টি বিশ্বনেতাদের জানান দিতে তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ রাষ্ট্রনায়কোচিত ভঙ্গিতে বীরদর্পে উচ্চারণ করেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ তখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বিনম্রতার সঙ্গে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত সম্মোহনী শক্তির মাধ্যমে বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জাতিসংঘকে ‘মানবজাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে তাঁর ভাষণ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ।’ বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা করেন।
৫
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারি তথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সবংশে নৃশংস ও নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। বাংলার আকাশে নেমে এল আবার প্রাগৈতিহাসিক ঘোর তিমিরাচ্ছন্নতা। তারপর রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে তাঁর নামধামও মুছে দেওয়া হলো ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে। ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হলো। ৭৫ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত ওইসব ঘৃণ্য ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল খুনিচক্র ও ষড়যন্ত্রকারীর যোগসাজসে বঙ্গবন্ধুর নামটিও ঐ সময়ে উচ্চারণ করা যেত না, করলে তা ছিল ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র শামিল।
কিন্তু ইতিহাস জেগে ওঠে। প্রকৃতি সজীব হয়। সময় কথা বলে। সত্য শক্ত হয়ে ওঠে। মাটি কেঁদে ওঠে। মায়েরা নিদ্রা ভাঙে। বাংলা তার আপন সত্তাটি খুঁজে নেয়। পাখির কিচির-মিচির সুরেলা হয়ে ওঠে। চরাচর ভেসে ওঠে সকল কুয়াশা ভেদ করে। প্রহরগুলো মিছিল করে তাদের ডানাদের রক্তাক্ত হওয়ার প্রতিবাদে। স্বদেশ তার আদলে ধীরে ধীরে প্রতিমূর্ত হয়ে ওঠে জাতির পিতার বজ্রকণ্ঠে, রবীন্দ্রনাথের গানে, নজরুলের দ্রোহী সত্তায়, জীবনানন্দের অপার বিস্ময়ে, সুকান্তের দৃপ্ত উচ্চারণে, আব্বাসউদ্দীনের ভাটিয়ালি সুরে, জসীমউদ্দীনের নকশিকাঁথায়, নির্মলেন্দু গুণের কাব্যিক ঔদার্যে, জয়নুল ও শাহাবুদ্দিনের অমর চিত্রকলায়, সংবিধানের সমুন্নত স্বাধিকারে, মানবতার জনজাগরণের অনন্য উষ্মীবতায়।
এভাবে মহাকালের অনেক উজ্জ্বল সময়ের প্রকৃষ্ট সাক্ষ্য হিসেবে জাতির পিতার মহান শাহাদতের শোকটি শক্তিতে পরিণত হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির প্রতিদিনের চর্যায়, সাহসে, সংগ্রামে, সাধনায়, সংগীতে, সাহিত্যে, কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে, উপন্যাসে, গবেষণায়, চিত্রকলায়, সুরম্যতায় এবং অন্বিষ্ট স্বপ্নের সমৃদ্ধ তথা একাগ্র তন্ময় ব্রততায়।
৬
বিশ্বের একমাত্র ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’খ্যাত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৪ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে ১০৪ তরুণ কবির কবিতা নিয়ে আমরা ‘তারুণ্যের স্পর্ধিত উচ্চারণ’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি। তরুণ কবি বলতে এখানে যাদের জন্ম ১৯৭৫ সালের পরে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে স্বচক্ষে দেখেননি, যাদের বয়স সর্বোচ্চ ৪৫-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ বা কাছাকাছি, তাদের কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ সংকলনে। আমরা চেয়েছি, হালের তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী কবিদের কাছে বঙ্গবন্ধু কতটুকু স্থান করে নিতে পেরেছেন, সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এবং তা জাতির উদ্দেশ্যে পেশ
করতে। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পেয়ে আমরা যারপরনাই আনন্দিত ও বিস্মিত। তাদের কবিতায় বিচিত্র উপমায়, বিনত ভঙ্গিতে, আশ্চর্য অভিব্যক্তিতে ও শিল্পিত চেতনায় বঙ্গবন্ধু যেভাবে চিত্রিত হয়েছেন, তা আমাদের আশান্বিত করে বইকি। তবে আপাত বিচারে কিছু দুর্বল কবিতাও এখানে স্থান পেয়েছে, সেটা কিছুটা সময় স্বল্পতার কারণে এবং কিছু তরুণের ঔদাস্য বা উন্নাসিকতার কারণেও। বঙ্গবন্ধু যে একজন পার্টিজান তথ্য দলীয় বৃত্তের উর্ধ্বের প্রাতিস্বিক ব্যক্তিত্ব ও জাতীয় গৌরবের অনির্বাণ পৌরুষ, সেই বিষয়টি
অনেক তরুণ কবি কেন জানি এড়িয়ে যেতে চান।
আমরা জানি, নিবেদিত কবিতায় কিছুটা আরোপণ, কিছুটা আতিশয্য, কিছুটা প্রগল্ভতা থাকেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাতর্পণের ভাষায় কোনো আতিশয্যই যে প্রকৃত আতিশয্য নয়, সেটা তাদের কীভাবে বুঝাই? বঙ্গবন্ধু যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি বিষয় বা উপজীব্য, সেটা তারা এখানো আমলে নিতে নারাজ। একুশ, একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু প্রভৃতি অনুষঙ্গে লিখিত বা উচ্চারিত দুর্বলতম ধ্বনিটিও যে একটি উৎকৃষ্ট উচ্চারণ বা কবিতা, সেটা যাদের অন্তরে দেশপ্রেম নেই, মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ নেই, স্বজাতির প্রতি অঙ্গীকার নেই, ইতিহাসের প্রতি অনুরাগ নেই, তারা জানবে না বা জানতে চাইবে না।
আমাদের স্পষ্ট প্রতীতি হচ্ছে, আজকের দিনে এসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে চর্চা বা গবেষণা না করলে, তা যে প্রতিটি বাঙালি ভাবুকের পাপ হবে, লেখকের কলঙ্ক হবে, গায়কের অসূয়া হবে, শিল্পের অন্ধত্ব হবে এবং এমন একটি গভীরতম প্রত্যয়বোধ থেকে আমরা একচুলও নড়তে চাই না।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
১৫ মার্চ ২০১৪
শাহবাগ, ঢাকা।