সম্পাদকীয় : সেলিম মোরশেদ সংখ্যা

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার লিভিং-লিজেন্ড, আমাদের কালের গোঁ

২০১৮ সালে লোক সাহিত্য পুরস্কারের জন্য সেলিম মোরশেদের নাম প্রস্তাব করা হলে তিনি সবিনয়ে জানিয়েছিলেন- ‘একটু ভেবে দেখি’। তারও অনেক আগে ২০০৯ সালে ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ সম্মাননা’ জানানোর জন্য তাঁর কাছে সম্মতি চাওয়া হলে তিনি ই-মেইল মারফত দীর্ঘ কথাবার্তা বলে সবিনয়ে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে লোক-এর সহযোগী পাল্টাপ্রতিষ্ঠান‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ-এর পক্ষ থেকে প্রতিবছর প্রকাশিত লিটলম্যাগসমূহ থেকে একটি লিটলম্যাগকে পুরস্কার (দশ হাজার টাকা) এবং একজন লিটলম্যাগ ব্যক্তিত্বকে সম্মাননা প্রদান শুরু হয়। প্রথমবার পুরস্কার পেয়েছিল লিটলম্যাগ ‘একবিংশ’এবং সম্মাননা জানানো হয়েছিল ‘ময়মনসিংহ জং’ সম্পাদক সরকার আজিজকে। পরের বছর অর্থাৎ ২০০৯ সালের জন্য সেলিম মোরশেদ অপারগতা প্রকাশ করায় ‘লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ সম্মাননা’ বন্ধ করে দেয়া হয়, তবে লিটলম্যাগ পুরস্কার অব্যাহত থাকে এবং ২০১৩ সালে সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি মেইলে যা জানিয়েছিলেন এখনো প্রাসঙ্গিক বিধায় তা এখানে তুলে ধরা হলো:

Dear Aniket Shamim,
As far as I know from our phone conversation and your email about your ‘Lifetime Achievement Honour and Award,’ which you are going to start from your Little Magazine Prangon, you wished for my cooperation. I’m a little aware of your hint that I’m somewhat mentioned for the honour by all of your judgments.

Frankly speaking, I don’t have disrespect about your activities but I have an attitude quite different from the attitude you have about little magazine activities. You will certainly realize that I’m not talking about myself, yet I’m supposed to say that since the 80’s in Bangladesh, many had a different and ‘alternative’ thinking. And they did a lot, too. But you know that I had to do a major work, Palta Kothar Sutramukh Othoba Buno Shuorer Goo, on the philosophy of little magazine movement in the context of Bangladesh. …Now the youngsters participate in the debate on little magazine movement against the media, the debate much inspired by the book I wrote. And you know I’m deeply wounded by the media’s harmful reactions to it. Not only that, I tried to base this little magazine movement on a philosophy politically and intellectually justified, even knowing that none of the philosophies is absolute in the end.

Along the way, I have lost many, many things while fighting in the movement in terms of my mental condition, social expectations about me and my family life. It’s now quite known to all for the internal bleeding in some of us.

I’m grateful to you because carrying the faded and torn flag for our little magazine movement, you are going on the path I built. I always encouraged you except in a few cases, and kept a friendly relationship with you all. …I repeat that I feel honoured by your judgments and your respectful attitude towards me. I have respect for those who will accept this award and honour. I’m feeling really bad and sad that I can’t take the honour from your Little magazine Prangon. This is not my rejection of the honour, and you know it will be somewhat painful for me to take it. I hope you won’t misunderstand me and our relationship will be what it was before. Thanks a lot.

Selim Morshed
March 13, 2009.

২০১৮ সালে ‘একটু ভেবে দেখি’র কয়েকদিন পর জানিয়েছিলেন— ‘এ-বছর না, পরের বছর ভাববানে’। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে যখন পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের সময় ঘনিয়ে আসছিল (লোক সাহিত্য পুরস্কারের নিয়ম হচ্ছে, যে বছর নাম ঘোষণা করা হয় তার পরের বছর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা হয় এবং তার পরের বছর সেই পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক সভাপতিত্ব করেন) তখন আবারও তাঁকে প্রস্তাব করে একটি সাবধান-বাণী করেছিলাম এরকম— অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার না করে নিজে নিজে ভাবুন, কট্টর লিটলম্যাগ সম্পাদক অর্থাৎ আপনি যে-সমস্ত লিটলম্যাগে লেখেন তাদের সঙ্গে আলোচনা/পরামর্শ করলে এ-বছরও আপনার নাম ঘোষণা করতে পারবো না। বরং আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করুন, কিংবা বড়জোর আপনার উদারপন্থী বন্ধু-পাঠকদের মতামত নিতে পারেন। আর যদি আবারও সেই পেছনে-টেনে-ধরাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেন তাহলে এ-পুরস্কার আপনি কখনোই নিতে পারবেন না। আমার এ বক্তব্য বা সাবধান বাণীতে বরফ গলতে থাকে। অবশেষে নিজের সঙ্গে নিজেই বোঝাপড়া করে এবং অনিন্দ্য সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদের অনুপ্রেরণায় তিনি পুরস্কার গ্রহণে সম্মত হন এবং ২০১৯ সালে কবি রহমান হেনরীকে প্রদত্ত পুরস্কার অনুষ্ঠানে সেলিম মোরশেদের নাম ঘোষণা করা হয়।

২.
কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ আশির দশকের লিটল ম্যাগাজিন মুভমেন্টের খাপখোলা তলোয়ার। প্রচল গড্ডলিকা প্রবাহের বাইরে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী আভাঁগার্দ শিল্প-কুশলী ও কারিগর হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় নিঃসন্দেহে। আশির দশক লিটলম্যাগহীন বাংলাদেশের ভুবনে লিটলম্যাগের উর্বর ও উজ্জ্বল সময়। সেই সময় থেকে হাতেগোণা যে-কয়েকজন উজ্জ্বল প্রতিভা লিটলম্যাগের দূরূহ ও দুর্মর পথ পাড়ি দিয়ে টিকে আছেন এবং বাংলাদেশে এখনও লিটলম্যাগ ছাড়া অন্য কোথাও লেখেন না তাদের মধ্যে সেলিম মোরশেদ প্রধানতম। কোনো খণ্ডিত বা বিশেষ-নির্বিশেষের দোলাচলের দাসত্ব মেনে নয়, জীবন ও পৃথিবীকে তিনি দেখেছেন সামগ্রিকভাবে, আর এই সামগ্রিকতার মূলে কাজ করেছে তার দার্শনিক অভিপ্রায়ের সমন্বয়ের চর্চা ও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মনোভঙ্গি। প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ছোটকাগজ ছাড়া অন্য কোনো পথে হাঁটেননি তিনি। পথটা ‘দুর্গম গিরি, কান্তার মরু’ মতো চড়াই-উৎরাইয়ে ঘেরা বন্ধুর ও কঠিন। তদুপরি স্বতন্ত্র এবং স্বনির্মিতপ্রয়াসী এ পথচলায় বলা যায় আজ তিনি নিঃসঙ্গ শেরপা।

তাঁর গল্প-উপন্যাসে নির্মম নিরপেক্ষ মহাকাল আর নিরন্তর টুকরো-হয়ে-যাওয়া অস্থির সময়কে উল্টেপাল্টে পাঠকের সামনে হাজির করেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনের নানাবিধ উথাল-পাতালও তাঁকে রুখতে পারে না; বরং সবই হয়ে ওঠে শিল্পকৃতির ইন্ধন। আর এ-কারণেই নিজেকে নিরন্তর প্রশ্ন করতে করতে, স্থিতাবস্থাকে ভাঙতে-ভাঙতে নিজের মানব-পরিসরকে তিনি নির্মাণ করেন নিজস্ব অবয়বে, ফলে তিনি হয়ে ওঠেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী ছোটকাগজের মশালচি। তাঁর বয়ানে যখন শুনি ‘আমরা যেন কখনো অ্যান্টি-পিপল না হই’ কিংবা‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা পুরো জীবন দেখার আর জীবনপ্রক্রিয়া বোঝার একটি মনোভঙ্গি’ তখন তাঁর প্রতি লাল স্যালুট জানাতে আমাদের আর দ্বিধা থাকে না।

সেলিম মোরশেদের গদ্যের স্টাইলে থাকে কাব্যময়তা এবং গদ্যের কোনো কোনো পঙ্ক্তি যেন হুবহু কবিতার আস্বাদ দেয়, ফলে তাঁর গদ্যস্থাপত্যে আমাদের মুগ্ধতা বাড়ে। আবার কোনো কোনো সময় তাঁর গল্পপাঠে মনে হতে পারে তিনি ইচ্ছে করেই জটিল ও ধোঁয়াশাপূর্ণ আবহ তৈরি করেন যাতে পাঠক অতি সহজেই তাঁকে পড়তে না পারেন। অধ্যাবসায়ী বা অনুসন্ধানী পাঠক না-হলে তাঁর গল্পের ভাঁজে ভাঁজে খুব সহজেই প্রবেশ করা যায় না। এমনকি তাঁর গল্পপাঠে কোমল স্বাদুতা বা মিষ্টি ঘ্রাণে বিমোহিত হবেন না তাঁর পাঠককুল। অর্থাৎ মোটাদাগে বলতে গেলে তাঁর গল্পভাষা সর্বত্র কমিউনিকেটিভ হয়নি এমনকি পাঠকবিচ্ছিন্নতারও জন্ম দিয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। তৎসম শব্দবহুলতা, অ্যাকাডেমিক ডিসকার্সিভ ভঙ্গি তাঁর গল্পকে করে তোলে একই সঙ্গে সংহত ও আড়ষ্ট। তবে কমলকুমার মজুমদারের মতো এই আড়ষ্টতাও কখনোবা উপভোগ্য হয়ে ওঠে। তাঁর গল্প জীবনের এক ভিন্ন টেরাকোটা- পোড়ো মাটিতে তিনি আঁকেন জীবনের নানা ভঙিমা।

বাংলা ছোটগল্পের ভুবনে তো বটেই, সেলিম মোরশেদের ‘কান্নাঘর’, ‘সখিচান’, ‘কাটা সাপের মুণ্ড’, ‘রক্তে যতো চিহ্ন’-অন্তত এই চারটি গল্প বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে তাঁকে স্থায়ী আসনে বসানোর মানদণ্ডে উপনীত।

আজ প্রায় চল্লিশ বছর তিনি, সেলিম মোরশেদ, এই কঠিন, স্বতন্ত্র এবং স্বনির্মিত পথ পরিক্রম করে চলেছেন সাহিত্যের সঙ্গে। নিজেকে নিয়ত রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত করে, নিরাবেগ বোঝাপড়ার মাধ্যমে তাঁর গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক এবং অন্যান্য লেখাতেও প্রতি মুহূর্তে লড়াই করতে করতে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বর্তমান। তাঁর এই দায়নিষ্ঠ শিল্প অভিযাত্রা সুদূরপ্রসারী, বাংলা সাহিত্যের সীমারেখাকে নতুনভাবে চিহ্নিত করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

বিদায় ঘণ্টাধ্বনি: লোক সাহিত্য পুরস্কার

লোক-এর দশ বছর পূর্তিতে ২০০৯ সাল থেকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়, আর বিশ বছর পূর্তিতে ২০১৯ সালে সেলিম মোরশেদকে পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দিয়ে লোক সাহিত্য পুরস্কারের ইতি টানা হয়েছে। ১১ বছরে ১২ জন (২০১৬ সালে যৌথভাবে) লেখককে লোক সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে, তারা হলেন : চঞ্চল আশরাফ, কুমার চক্রবর্তী, মুজিব মেহদী, মাহবুব কবির, ইমতিয়ার শামীম, কামরুজ্জামান কামু, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মোস্তাক আহমাদ দীন-আহমেদ স্বপন মাহমুদ, সলিমুল্লাহ খান, রহমান হেনরী, সেলিম মোরশেদ।

শুরু থেকেই লোক সাহিত্য পুরস্কারের জন্য তাদেরকেই নির্বাচন করা হয়েছে- যাঁরা বড়ো কোনো পুরস্কার পাননি, লেখক হিসেবে যথেষ্ট সম্ভাবনাময় অথচ অনালোচিত/অনালোকিত থেকে গেছেন, বড়ো কাগজে লিখলেও সাহিত্যের বাজারি প্রপাগাণ্ডায় নিজেকে ভাসিয়ে দেননি- তাদেরকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। যদিও লোক সাহিত্য পুরস্কারের শুরুতে একটি ঘোষণা দেয়া হয়েছিল- এ পুরস্কার নব্বইয়ের দশকের লেখকদের দিয়ে শুরু হয়েছে যা ক্রমান্বয়ে তরুণদের দিকে যাবে। তবে এ ঘোষণার ব্যত্যয় হয়েছে কয়েকবার।

বিভিন্ন কারণে আমার কাছে মনে হয়েছে- এবার থামা উচিৎ, ব্যস। কারণগুলো না-ই বা বললাম, লোক-এর গুণমুগ্ধ এবং সমালোচনাকারীরা নিজের মতো করে ভেবে নেবেন। আর তাছাড়া, জীবন চলার পথে কোথায় থামতে হয়, সেটা জানতে হয়। তা-না হলে বিড়ম্বনাই শুধু বাড়ে। মনের গহীন কোঠরে কিছু ক্লেদ-ক্ষোভ-অভিমান জমা থাকাই ভালো।

নব্বইয়ের পরবর্তী কোনো লেখককে লোক সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করতে পারিনি, এ দায়ভার ও অনুশোচনা মেনে নিয়েই বলতে চাই— নব্বইয়ের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ যদি উদ্যোগ নেন কিংবা এখনও অনেক ভালোমানের যে লিটলম্যাগ বেরুচ্ছে তাদের পক্ষ থেকে কেউ উদ্যোগ নিলে অগ্রিম সাধুবাদ ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত থাকবে। নোতুন চিন্তা-চেতনা তো তরুণদের মধ্য থেকেই উঠে আসবে, তাদের জন্য পথ ছেড়ে দিতে হয়। পরিশেষে বলতে চাই, লোক সাহিত্য পুরস্কার ইতি টানলেও, আরও দু’চার বছর হয়তো নিয়মিত কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হবে লোক-এর। তবে পঁচিশ বছরের পর আর কোনোভাবেই না।

অনিকেত শামীম
সম্পাদক, লোক

শেয়ার করুন:

আরো...

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো...

‘লোক’-এর রজতজয়ন্তী আয়োজন

বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিস্ময় জাগানিয়া লিটলম্যাগের নাম ‘লোক’। কবিতা যার প্রাণ। চিন্তাচর্চা ও গবেষণা যার অনুধ্যান। জনমানসের মর্মমূল ছুঁয়ে

Read More
Scroll to Top