অশেষ প্রস্তরযুগ থেকে উঠে আসা মানবিক বিবর্তনের কবি
কবিতার জগতে আমি যখন গভীরভাবে নিমজ্জিত অর্থাৎ জামালপুর-পর্ব, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-পর্ব শেষ করে ঢাকায় থিতু হই, সেই ১৯৯১-৯২ সাল থেকেই কবি শোয়েব শাদাবের নাম শুনে আসছি। শাহবাগের পিজি চত্বরে দু-তিনদিন কথাও হয়েছে স্বল্প পরিসরে, সেই পর্যন্তই। এরপর বহু আড্ডা-আলোচনায় শোয়েব শাদাবের প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু শোয়েব শাদাবকে নিয়ে কোনো লেখালেখি বা তাকে কেন্দ্র করে কোনো কিছু করার জন্য কাউকে কখনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখিনি। শুনেছি, বছর ৬/৭ আগে, অনিন্দ্য সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ তাকে নিয়ে একটি সংখ্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, বন্ধুমহলসহ বিভিন্নজনকে শোয়েব শাদাবের কবিতাসংগ্রহও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু একটি লেখাও পাওয়া না-যাওয়ায় তার সেই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। আরেকটি লিটলম্যাগ, যেটি শোয়েব শাদাবকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আত্মশ্লাঘায় ভোগেন, তাদেরও কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। অথচ সেই লিটলম্যাগেরই উচিত ছিল তাকে নিয়ে বেশি সরব থাকার। সেল্যুকাস! হায়, যে লিটলম্যাগটির জন্য শাদাব নিজের সৃষ্টিশীল সময়কে উজাড় করে দিয়েছিলেন, তাদের প্রশ্নোদ্রেককারী সীমাহীন নীরবতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে।
বিগত ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বরে জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠিত কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদকে পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে লোক সাহিত্য পুরস্কার বন্ধ করার ঘোষণা দিই, আমার স্বাগত বক্তব্যে। অনুষ্ঠানের শেষদিকে, সেলিম মোরশেদ তার পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশের বক্তব্যের শেষপর্যায়ে তার পুরস্কারপ্রাপ্ত নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা লোক সম্পাদকের কাছে গচ্ছিত রাখেন, এই বলে যে- ‘ভবিষ্যতে যদি লোক আশির দশকের কোনো কবি-সাহিত্যিক নিয়ে কাজ করে, যেমন- শোয়েব শাদাব, শান্তনু চৌধুরী, সাজ্জাদ শরিফ বা বিষ্ণু বিশ্বাস; তখন এই টাকাটা যেন সেই কাজে সদ্ব্যবহার করা হয়।’
পরবর্তী সময়ে, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ময়মনসিংহে একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে সেলিম মোরশেদ, আযাদ নোমান, মাহবুব কবির, রিপন আহসান ঋতুসহ কয়েকজন যাত্রাকালে ত্রিশাল অতিক্রমের সময় সেলিম মোরশেদ, আযাদ নোমান বলে উঠেন- আশেপাশেই শাদাবের বাড়ি। এবং যতক্ষণ গাড়িতে ছিলাম, ততক্ষণই শোয়েব শাদাব প্রসঙ্গে দুইবন্ধু আলোচনা মাতিয়ে রাখলেন। আমার জানা ছিল না, শাদাবের বাড়ি ত্রিশালেই। আমি তাদেরকে সিদ্ধান্ত জানালাম, আগামীকাল ৬ ফেব্রুয়ারি ফেরার পথে আমরা অবশ্যই শাদাবের বাড়ি যাবো। সবাই খুবই উচ্ছ্বসিত। শাদাবের পরিবারের কারো ফোন নাম্বার না থাকায় কোনোপ্রকার যোগাযোগ ছাড়াই যথারীতি আমরা শাদাবের জন্য সিগারেট, ফলমূল নিয়ে তার ফকিরবাড়ি হাজির হলাম। বিদায়ের সময় শাদাব বারবার বলছিলেন, ‘আমারে ঢাকাত নিয়ে যাওনজে।’
গত ১২ মার্চ ২০২১, মুক্তাগাছায় আরেকটি সাহিত্য অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে ১৩ মার্চ আবার আমরা ফকিরবাড়ি যাই, জানান দিয়ে। এর আগেই ফেব্রুয়ারির শেষদিকে শাদাবের ছোট ভাই, বর্তমান সাখুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, শাহ মো. গোলাম ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই যে, ১৯ মার্চ ঢাকার সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে শাদাবকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করবো। ঢাকায় আসার জন্য শাদাবের সে কী আকুতি। বারবার আমাদের বলছিলেন, ‘ইয়াহিয়া কি রাজি অইছে নি?’ এরই ধারাবাহিকতায় আমরা সিদ্ধান্ত নিই, শোয়েব শাদাবকে নিয়ে লোক-এর একটি সংখ্যা করবো।
২
স্বাধীনতা-উত্তর এই ভূখণ্ডে যখন অভাবনীয়-রূপে সামরিক দুঃশাসন জেঁকে বসেছিল, রাজনৈতিক অস্থিরতায় মুড়মুড় করে ঢুকেছিল দুর্বৃত্ত পুঁজির অনাকাঙ্ক্ষিত ঢেউ; যখন গণমাধ্যম ছিল উন্মুল, দিগ্ভ্রান্ত আর দিশেহারা। আত্মস্থ হওয়া সংস্কৃতি থেকে ধর্ম বের হয়ে কুঠারাঘাতের মুখোমুখি হলো- এখনও যার দায় বহন করতে হয় আমাদের; সেই প্রাক্-আশির দশকে বাংলা কবিতার যে অনুশীলন চলছিল, তা ছিল কিছুটা স্লোগানমুখর এবং তাৎক্ষণিক দ্রোহের প্রতিবিম্ব। পরবর্তীকালে সেগুলো সাহিত্যের নান্দনিক অবস্থান থেকে সরে গিয়ে বিক্ষিপ্ত জাতীয়তাবাদের দিকেই টার্ন নেয়। এমন একটি সময়ে, বলা যায়, আশির দশকের শুরুতে, গুটিকয় ছোটকাগজের বিশ-পঁচিশজন কবি-শিল্পী- সাহিত্যিক-সম্পাদক মোকাবেলায় নেমেছিলেন। অন্তত ওই মুহূর্তে, রাষ্ট্র-সমাজ-দেশের চেয়েও তাদের কাছে জরুরি মনে হয়েছিল, বেনিয়াবৃত্তির ওই বৈপরীত্বে নিজস্ব শিল্পসত্তাকে বাঁচানো। তিন-তিনটে যুগ-পরবর্তী আজ প্রমাণিত, আশির ছোটকাগজ-আন্দোলন বাংলাসাহিত্যে অপরিহার্য একটি ধারাই শুধু নয়, তরুণ প্রজন্মের কাছে অদম্য আকাঙ্ক্ষাই শুধু নয়, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুগুলোর ওপরও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষণীয়।
সেই লক্ষণ-আক্রান্ত সময়ে, শুরু থেকেই ওই সাংস্কৃতিক যুদ্ধে একজন অগ্রগামী শব্দসৈনিক হয়ে আবির্ভূত হলেন কবি শোয়েব শাদাব। হাপুন হাতে, শত বৈপরীত্বে, যিনি নিজেই মূর্তি হলেন প্রাগৈতিহাসিক মানবিক পাথরের।
তার সেই পাথরে উৎকীর্ণ প্রত্নকবিতা নিয়ে আমাদের এইটুকু বলার আছে, দীর্ঘদিন বাংলা কবিতায় আত্মগত-সংকট আর বিমূর্ত-মননে যেভাবে চলছিল, শোয়েব শাদাবের কবিতা সেখানে বড়ো একটা ব্যতিক্রম এজন্য যে, তার কবিতায় টেক্সট সার্ভের অবকাশ থাকে- যা একজন প্রকৃতিপ্রদত্ত কবির পক্ষেই সম্ভব। শোয়েব শাদাবের কবিতায় আমরা পাই মানুষিক অতল অবগাহন। হৃদয়বৃত্তির নির্মোহ অভীলা, ইতিহাসের হাসি-কান্না, সত্যের স্বতঃস্ফূর্ত উন্মোচন, চরাচরের প্রতি মমত্ববোধ এবং একটি বীর্যবন্ত সত্তার অপরাজেয় অনুভব।
মানবিক বিবর্তনের সময় থেকে আজ অবধি সত্তার যতো প্রবণতা আর অস্তিত্বের অনিবার্য দিকগুলো শাদাবের কবিতায় যেভাবে অবলীলায় চিহ্নিত হয়েছে, সেই-অর্থে বাংলা কবিতাকে তিনি খানিকটা ঋণীই করে গেলেন।
এ সংখ্যায় সর্বমোট ৭৩ জনের লেখা মুদ্রিত হলো। সংখ্যার কাজ যখন শেষপর্যায়ে, তার পরও ৩-৪টি লেখা মেইলে এসেছিল, যেগুলো ছাপানো সম্ভব হলো না। ৭৩ জনের স্বতঃস্ফূর্ত ও বহুমাত্রিক লেখায় সমগ্র শোয়েব শাদাবের সারাৎসার উঠে এসেছে। তার পারিবারিক জীবন, কবিতার নবিশিকাল, কবিতাজীবন, সিজোফ্রেনিয়া- কাল ছাড়াও তার কবিতার নানা মাত্রিকতা, আসিক ও বিচিত্র বিশদকথা উঠে এসেছে। তারা বিস্মিত হয়ে প্রকাশ করেছেন তাদের অভিব্যক্তি ও আন্তরিক মূল্যায়ন। কবি শোয়েব শাদাব এবং তার কবিতা- এ দুটি বিষয় এতটাই নিবিড় যে, লেখকদের ঐকান্তিক মূল্যায়নে কবির চেতনবিশ্ব বা গভীর অনভূতি স্পর্শের ক্ষেত্রে কোথাও কোনো বিঘ্ন হয়েছে বলে মনে হয়নি।
শোয়েব শাদাবকে নিয়ে লোক-এর এ সংখ্যা প্রকাশের পাশাপাশি, তাকে নানাভাবে সম্মাননাও জানানো হচ্ছে। এ সংখ্যার মোড়ক উন্মোচনের দিনে তাকে সংবর্ধিত করা হবে লোক-এর পক্ষ থেকে। তাছাড়া, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও তাকে সংবর্ধনা জানানো হচ্ছে। এ আমাদের জন্য যুগপৎ আনন্দ ও গৌরবের বিষয় বৈকি।
শোয়েব শাদাব বর্তমানে অনেকাংশে সুস্থ। গত ১৯ মার্চ সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে তাকে আমরা যতটা প্রাণবন্ত দেখেছি, যেভাবে অনর্গল মুখস্থ কবিতা পড়েছেন, তাতে মনে হয়েছে আরেকটু পরিচর্যা এবং কবিতাময় পরিবেশ পেলে তিনি আবার কবিতার ভুবনে ফিরে আসতে পারবেন। আমাদের প্রাণান্ত আহ্বান, ত্রিশ বছরের পাথুরে মৌনতা ভেঙে তিনি আলোকস্তম্ভ হয়ে কবিতার কাছে ফিরে আসবেন। সময়ের স্রোতধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিস্মৃতির অতল গহীনে হারিয়ে যাওয়া কবি ফিরে পাবেন তার স্মৃতি এবং দাঁড়াবার ভিত।
নব্বইয়ের বন্ধন সংখ্যা
লোক-এর পরবর্তী আয়োজন ‘নব্বইয়ের বন্ধন সংখ্যা’। সংখ্যাটি ২০২১ এর বইমেলায় প্রকাশের জন্য প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল, কিন্তু সংখ্যাটিকে আরও পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্য কয়েকটি গদ্য/নিবন্ধের অপেক্ষায় ছিলাম। জানুয়ারি ২০২২-এ সংখ্যাটি প্রকাশিত হবে।
অনিকেত শামীম
সম্পাদক, লোক