জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘তারুণ্যের স্পর্ধিত উচ্চারণ: বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা’ শিরোনামের এই কবিতা-সংকলনটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো জাতির পিতার ১০৪তম জন্মদিনে ১০৪ তরুণ কবির শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। বঙ্গবন্ধু ঘাতকের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ভোররাতে, আজ থেকে ৫০ বছর আগে। এই সংকলনভুক্ত ১০৪জন কবির সকলেই জন্মগ্রহণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর শাহাদত-বরণের পরে; ফলে কারোই বঙ্গবন্ধুকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এই কবিদের মধ্যে কেউ কেউ চল্লিশোর্ধ্ব। তারা দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন, আবার অনেকে আছেন সবে পদার্পণ করেছেন কবিতার জগতে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা হয়েছে অগণিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। জীবদ্দশায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক মানুষ। পাকিস্তানি শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তাঁর অবিস্মরণীয় নেতৃত্বে বাঙালির ইতিহাসের গতিপথ বদলে গেছে। বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র। বাঙালি কবি লেখক শিল্পীরা বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই আবিষ্কার করেছেন জাতির অন্তরাত্মা ও শৌর্য-বীর্য।
৭ই মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্যিক ভাষণ যাকে কবি জসীমউদদীন তুলনা করেছেন ‘বিসুভিয়াসের অগ্নি উগারী বানের’ সঙ্গে জাতিকে নিয়ে গেছে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। স্বাধীনতা পূর্বকালে ও মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রত্যয়ী দিনগুলোতে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরে তাঁর স্বল্পকালীন দেশ-পরিচালনার সময় বাঙালি কবিরা অনেক উজ্জ্বল পঙক্তি রচনা করেছেন। কিন্তু মৃত্যুর পরে তিনি যুগপৎ হয়ে ওঠেন বীরত্ব ও শোকের প্রতীক। তাঁর নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে রচিত হয়েছে বহু সাহসী কবিতা। ১৯৭৫ সালের পরে বাংলা কবিতায় তাঁকে ঘিরে প্রতিবাদী ধারার সূচনা হয়। পৃথিবীতে অনেক বিখ্যাত নেতার হত্যা বা প্রয়াণের পরে অনেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে কবিতা লিখেছেন। সিমন বলিভার, মহাত্মা গান্ধী, আব্রাহাম লিংকন, জন এফ কেনেডি, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু– এরকম অনেককে নিয়ে লেখা হয়েছে বহু কবিতা কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শোক ও প্রতিবাদের যে কাব্যধারার সূচনা হয়েছে, তা শুধু এই উপমহাদেশে নয়, পৃথিবীতেও বিরল।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরে বাংলাদেশ উলটো পথে হেঁটেছে বহুবছর— ঘাতক, স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি ও সামরিক শাসকদের জগদ্দল পাথর চেপে বসেছিল জাতির ঘাড়ে। বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রকাশ্যে শোকপ্রকাশ ছিল অপরাধ! জাতির দুর্ভাগ্য, জনকের শেষকৃত্যে সামিল হতে পারেনি জনগণ। এই গভীর শোক ও মর্মবেদনা পরিণত হয়েছে চিরকালীন শোকের মাতমে। যে শোক জাতি একদিন প্রকাশ করতে পারেনি, সেই শোক রূপ নিয়েছে বহমান স্রোতে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এখন অন্তহীন সৃজনশীলতার উৎস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাহিত আছেন টুঙ্গিপাড়ায়। কিন্তু স্মৃতিতে, শ্রদ্ধায় সাহসে ও উজ্জীবনে তিনি পরিচিত সারা পৃথিবীতে। বিশ্বে তিনিই একমাত্র রাজনীতিবিদ, যাকে অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ হিসেবে।
যা কিছু শ্রেষ্ঠ শেষাবধি তাই কবিতা— শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মে যেমন ঘটে কবিতার প্রতিভাস, তেমনি রাজনীতিও হয়ে উঠতে পারে শ্রেষ্ঠ কবিতা, যদি তাতে জাতির অন্তরাত্মার সঙ্গে একাকার হয়ে যায় মানুষের মিলিত স্বপ্ন। এ কাজটি করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর দৃপ্তকণ্ঠের প্রতিটি উচ্চারণ ছিল মহাকাব্যিক আলোর স্ফুরণ। শোকের নানা রং আছে, তাতে ব্যক্তির আবেগ যেমন মিশে থাকে, তেমনি দেশ ও পরিপার্শ্বের সব রঙও বিস্তার পায়। বাঙালি কবিরা তাদের সকল উজ্জ্বল পঙ্ক্তিতে আবেগকে যেমন ধারণ করেছেন, তেমনি দেশের রূপ-রস-গন্ধ, উড্ডীন পতাকার লাল সবুজ সবকিছু তুলে ধরেছেন কবিতার পরতে পরতে। বঙ্গবন্ধুকে যারা দেখেছেন, তাঁকে নিয়ে তাদের আবেগ আছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আবেগ। সমসাময়িক কবি, যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখেননি তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে যে আবেগ তা গৌরবের ইতিহাসের, দেশপ্রেমের। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দেশ ও জাতির আত্মাকে তারা তাদের প্রজন্মের চোখে আবিষ্কার করে চলেছেন নিরন্তর। তরুণ কবিরা তাঁকে ঘিরে যেন বাংলাদেশের অবয়ব রচনা করেছেন, যা ছড়িয়ে আছে বাঙালির বহমান জীবনধারায়। প্রতিবাদের সেই কাব্যধারা এখন স্মৃতি-শ্রদ্ধার অপরূপ নিবেদন।
এই সংকলনভুক্ত কবিতাগুলোতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সরাসরি কবিতা রয়েছে, আবার কিছু কবিতা আছে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। বঙ্গবন্ধু নানা রূপকে উপমায় এখানে বলিষ্ঠভাবে ধরা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সৃজনশীল কাব্যধারার এই প্রয়াস কখনো থেমে থাকবে না। মানুষ বেঁচে থাকে তার অর্জন এবং গৌরবে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন বাঙালির অন্তহীন ভালোবাসায়, তাঁর অর্জন ও গৌরবে। তাঁর অনন্য গৌরবের উচ্চতার ছায়াতলে তরুণ কবিদের উজ্জ্বলতম পঙ্ক্তিতে রচিত হচ্ছে শ্রদ্ধা-ভালোবাসার নানা অনুভবের কবিতা। এ এক অনিঃশেষ কাব্যধারা।
সম্পাদক ও কবি অনিকেত শামীমকে বিশেষ ধন্যবাদ এই সংকলনটি প্রকাশ করার জন্য। যে সব তরুণ কবির কবিতায় ঋদ্ধ এই সংকলন, তাদের সকলের প্রতি রইল অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শুভকামনা।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।