বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নেতা তিনি; বিবিসির জনমত জরিপে এ তথ্য প্রমাণিত। ঐ জরিপ না হলেও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের এতটুকু ঘাটতি হতো না। কেননা বিশাল এ বাংলা—ভূখণ্ড শত শত বছর ধরেই ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি। এক উপনিবেশ থেকে ঢুকেছে আর এক উপনিবেশের খাঁচায়। অনিচ্ছুক এই বন্দিত্ব বাংলাদেশ এবং বাঙালিকে মেনে নিতে হয়েছে। বর্গী, পতুর্গিজ, মোঘল, পাঠান, বৃটিশ, পাকিস্তানি শাসকসহ ভিনদেশি শাসকরা প্রাচীনকাল থেকেই লুণ্ঠন করেছে বাংলার সম্পদ। এর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন—সংগ্রাম হয়নি, তা নয়। বহু সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের ইতিহাস জীবন্ত এখনো। কিন্তু সেসব আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলবো, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে যে অসাধ্য সাধন করে গেছেন, তা আর কারো পক্ষেই করা সম্ভব হয়নি। পরাধীনতার গ্লানির পঙ্কে ডুবন্ত একটি জাতিকে মুক্ত করেছিলেন তিনিই এবং তাঁর অতুলনীয় সাহসী নেতৃত্বের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে।
বিশ শতকের চল্লিশের দশকে পকিস্তান আন্দোলন, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ক্রমাগত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় পূর্ববাংলার মানুষের মধ্যে ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধু যে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, তা ছিল সুদূরপ্রসারী এবং দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। যে কারণে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসকরা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামোয় ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে দেবার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন এই স্বাধীনতায় বাংলার মানুষের মুক্তি আসবে না। পাকিস্তান আন্দোলনের নেপথ্যে তাঁর স্বপ্ন ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলা— এই তিনটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যে ভ্রান্ত দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে কথাও তাঁর আগে কেউ উপলব্ধি করতে পারেননি। কারণ, মানুষের জীবন পরিচালিত হয় তার ভাষা, সংস্কৃতি তথা জীবনাচারের ওপর নির্ভর করে। ধর্ম হচ্ছে সেই বিশালায়তন সংস্কৃতিরই একটি অংশ মাত্র। ধর্মের ওপর ভিত্তি করে একটা রাষ্ট্র যে গঠিত হতে পারে না এবং গঠন করা হলেও যে তা টেকে না, তার জ¦লন্ত প্রমাণ পাকিস্তান রাষ্ট্রটির একাংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা স্বাধীন সার্বভৌম এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর থেকেই ‘পাকিস্তান’ শব্দটি পছন্দ করতে পারেননি। এমনকি পূর্ববাংলাকে ‘পূর্বপাকিস্তান’ নামে প্রতিষ্ঠারও ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। যে কারণে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন এই বলে যে, পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করতে হলে জনগণের ম্যান্ডেট তথা গণভোট দিন। পূর্ববাংলা নামটির সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের মানুষের ভাষা—সংস্কৃতি—রুচিসহ এক দীর্ঘস্থায়ী আবেগ, সেটাও বঙ্গবন্ধুর আগে কেউ বোঝেননি।
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের সাধনা শুরু হয়েছিল বলতে গেলে ১৯৪৮ সালের গোড়া থেকেই। ছাত্রলীগ গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলার ছাত্র—তরুণদের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগিয়ে তোলা, ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ দলটিকে অসাম্প্রদায়িক রূপ দিতে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ— এ সবই ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক, সুখী—সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগঠনের দিকে যাবার প্রক্রিয়া।
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত ‘পূর্বপাকিস্তান’ বাস্তবতার মধ্যে বসে ধর্মনিরপেক্ষ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা সহজ ছিল না। ঘরে—বাইরে দুদিকেই ছিল প্রবল প্রতিরোধ তথা ধর্মান্ধতার প্রাচীর। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ধর্মানুরাগী কিন্তু বিরোধী ছিলেন ধর্মান্ধতার। অন্যদিকে পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকরা ধর্মের নামে বাংলার সম্পদ লুট করার জন্য বাংলাদেশকে তাদের চিরস্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করতে চেয়েছিল। গভীর দূরদৃষ্টি, অসীম সাহস, অতুলনীয় দেশপ্রেম– এই ত্রিশক্তিকে সম্বল করে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেই ধর্মবর্ণ নির্বিশেষ বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলমুক্তির ডাক দেওয়া সেজন্যই বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল।
এমন দেশপ্রেমিক, অসম সাহসী মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্র—প্রতিষ্ঠার জন্য সফল একটা মুক্তিযুদ্ধ হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু স্বাধীনতা—বিরোধীরা তো বটেই, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একটি মহলও দেশি—বিদেশি প্ররোচনা আর চক্রান্তে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতার এই মহান স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করে। বাংলাদেশের জন্য তা ছিল এক চরম বিপর্যয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের সচেতন, কবি—সাহিত্যিক, শিল্পী—সাংবাদিক—শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মীসহ প্রগতিশীল অংশটি তাদের সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে জাতির পিতাকে হত্যার প্রতিবাদ করেন এবং সেই ধারা আজও বহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় লেখালেখি হয়েছে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে ‘মুজিববাদ’ শিরোনামে গ্রন্থ রচিত হয়েছে, তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার পরও দেশ—বিদেশের বহু লেখক—কবি—সংস্কৃতিকর্মী প্রতিবাদ করেছেন তাদের সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে।
দেশের অভ্যন্তরে লেখক—শিল্পীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার যেমন প্রতিবাদ করেছেন, তেমনই ভারতবর্ষের প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়সহ বিভিন্ন দেশের বরেণ্য লেখকরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে কবিতা লিখেছেন। এমনকি ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজ, পাকিস্তানের ফয়েজ আহমদ ফয়েজ—এর মতো বিখ্যাত কবিরাও বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ক্যারিশমায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লিখে পাকিস্তানেই কারাবরণ করেছেন উর্দুভাষী কবি আহমেদ সালিমের মতো একাধিক কবি—সাংবাদিক। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল সম্পাদিত ‘সাহিত্যের শুভ্র কাফনে শেখ মুজিব’ কাব্য—সংকলনে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার কবিদের কবিতা পড়লে আজও আমরা বঙ্গবন্ধুর বিশালতায় মুগ্ধ হই।
পঁচাত্তর পরবর্তীকালে ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’সহ বেশ কয়েকটি কবিতা ও ছড়া—সংকলন প্রকাশ করে আমাদের কবি—সাহিত্যিকরা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামমুখর জীবন ও আদর্শ নিয়ে লেখার একটি নতুন স্রোত প্রবাহিত করেছেন বাংলাদেশের সাহিত্যে। ১৯৭৮ থেকে ক্রমাগত সেই ধারা প্রসারিত হয়েছে। অবশ্য পঁচাত্তর পূর্ববর্তীকালে তথা ষাটের দশকেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুয়েকজন লিখেছেন। এঁদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণের কথা সবাই জানি। তাঁর ‘হুলিয়া’ কবিতায় স্পষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হয়েছিল।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখির পথটা কণ্টকিতই ছিল এবং গণমাধ্যমও নির্দ্বিধায় লেখা প্রকাশ বা তাঁকে নিয়ে আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। এর কারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যা—পরবর্তী সরকারগুলো বঙ্গবন্ধুর নামটি মুছে দেবার চেষ্টা করেছে সচেতনভাবে এবং ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানটির চিহ্নও মুছে দেবার জন্য এটিকে গাছপালা লাগিয়ে উদ্যানে পরিণত করে। কারণ, এই উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়েই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলার মানুষকে প্রথম জানিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু হত্যা—পরবর্তী শাসকদের চেষ্টা ছিল ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা দেশবাসীকে ভুলিয়ে দেওয়া।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখালেখির অবাধ—গতি আসে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর। যদিও ২০০১ সালের অক্টোবরে বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘নিরপেক্ষতার প্রহসনে পরিচালিত’ নির্বাচনে বিএনপি—জামাতকে ক্ষমতাসীন করার পর বঙ্গবন্ধু বিষয়ক লেখালেখির ধারা পাঁচ বছর কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
২০০৮ সালের সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত দু’বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা আরেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নিরঙ্কুুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক লেখালেখির ধারা এতটাই গতি লাভ করেছে যে, অসংখ্য কবিতার বই এবং সংকলন প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। ২০২০ সাল ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। জাতীয়ভাবে জাতির পিতার জন্মোৎসব উদযাপনকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যেমন, তেমনই বিভিন্ন সাহিত্য—সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, বেতার টিভিসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম, গণমাধ্যম, সোস্যাল মিডিয়া বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য লেখা প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গণমাধ্যমে এ যাবৎ শত শত গান প্রচারিত হয়েছে। কয়েকশ গল্প রচনা করেছেন আমাদের কথাসাহিত্যিকগণ। নাট্যকারগণ রচনা করেছেন মঞ্চ আর বেতার—টিভিতে প্রচারের জন্য বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বহু নাটক। নাটকের বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। গবেষণামূলক প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়ণধর্মী গদ্য রচনার সংখ্যাও কয়েক হাজার, যার অধিকাংশই স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক সম্পাদিত বিভিন্ন গ্রন্থে। বাংলাদেশের চিত্রকলাতেও বঙ্গবন্ধুকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করেছেন চিত্রশিল্পীরা।
একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত স্মৃতিময় ইতিহাসের আলোকে যেমন বাংলাদেশের সাহিত্যে একটি নতুনধারা গড়ে উঠেছে, তেমনই বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও তাঁর আত্মত্যাগের, সাহসের, ঔদার্যের নানা ঘটনা অবলম্বনে এদেশে ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ধারা। আমাদের প্রবীণ কবি—সাহিত্যিক থেকে শুরু করে আজকের অতি তরুণ কবি—সাহিত্যিক এবং সাহিত্য যশোপ্রার্থীরাও বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে রচনা করে চলেছেন নতুন নতুন গান, ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ এবং অনেকে করে চলেছেন গবেষণাকর্মও।
গত অর্ধ শতাব্দীর সামাজিক—রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার দিকে তাকালে এ সত্য যে কেউ উপলব্ধি করবেন যে, বাংলাদেশের বাঙালিই সেই দুর্ভাগা জাতি, যারা দাঁত থাকতে তাঁদের কদর করতে জানলো না। যিনি হাজার বছরের পরাধীনতা থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করেছিলেন নিজের জীবন বাজি রেখে, সেই স্বাধীনতার মহান স্থপতিকেও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি পুনর্গঠনকালে একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়নি বাংলাভাষী কতিপয় বিশ্বাসঘাতক! সবচেয়ে দুর্ভাগ্য এ জাতির যে, তারা জাতির পিতাকে রক্ষাও করতে পারল না! স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তাঁকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হলো ঘাতকদের হাতে! যিনি তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার মধ্যদিয়ে বাংলার মানুষকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকারী করলেন, সেই জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশেরই দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থান্ধতা তাঁকে স্বাধীনতার মহান স্থপতি তথা জাতির পিতা হিসেবে মেনে নিতেও পারল না সাম্প্রদায়িক রাজনীতিপুষ্ট একটি মহল। পৃথিবীর কোনও দেশে বোধকরি জাতির পিতা প্রশ্নে কোনও ভিন্নমত নেই, একমাত্র বাংলাদেশই ব্যতিক্রম।
বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম, অনন্য সাহসী সংগ্রাম যেমন এই সংকলনভুক্ত কবিতামালায় তরুণ কবিরা চিত্রিত করেছেন, তেমনই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যার প্রতিবাদ, ক্ষোভ—আক্ষেপ এই সংকলনভুক্ত ১০৪টি কবিতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তরুণ কবিদের মৌলিক উচ্চারণে। বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত উল্লেখযোগ্য কবিরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখছেন অনেকদিন ধরে। আমরা ঘুরে ফিরে তাঁদের কবিতাই বিভিন্ন কাব্যসংকলনে দেখছি— যেখানে বঞ্চিত হন তরুণ কবিরা। সেই বঞ্চনার বিপরীতে কবি অনিকেত শামীম সম্পাদিত তরুণ কবিদের এ সংকলন এক উজ্জ্বল দ্রোহ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে এবং তারও আগে থেকে ১৫ আগস্ট স্মরণেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক কবিতা—সংকলন প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু সেসব সংকলনে পঁচাত্তর পরবর্তীকালে জন্মগ্রহণকারী এসব কবির কবিতা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এদিক থেকে বিবেচনা করলে অনিকেত শামীমের এ উদ্যোগ সচেতন পাঠকমাত্রকেই মুগ্ধ করবে। দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন ‘লোক’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে শামীম সাহিত্যের সংগঠক হিসেবে নিজেকে যেমন দক্ষ থেকে দক্ষতর করে তুলছেন, একইভাবে তার সমসময়ের কবি—লেখকদের নিয়েও অনেক কিছু করতে সর্বদাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জাতির পিতার ১০৪তম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে ‘তারুণ্যের স্পর্ধিত উচ্চারণ: বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতা’ শিরোনামে এই কাব্যসংকলন সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে আমার বিবেচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করলেন কবি অনিকেত শামীম। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, গত শতাব্দীর চল্লিশ—পঞ্চাশ দশকের কবিদের প্রায় কেউ বেঁচে নেই অর্থাৎ একটি প্রখর স্রোতোধারা চিরদিনের জন্য থেমে গেছে। যাটের দশকের দু—চারজন বেঁচে থাকলেও সে ধারাও স্তিমিত প্রায়। আমরা যারা সত্তর দশকে শুরু করেছিলাম, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কবি এরই মধ্যে প্রয়াত। অন্যরাও প্রায় জীবনসায়াহ্নে। আমাদের এক দশক পরে যারা শুরু করেছিলেন, তারাও অনেকেই এখন ষাটের ঘরে, হাঁটছেন বার্ধক্যের দিকে। এ অবস্থায় অনূর্ধ্ব পঞ্চাশ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যা—পরবর্তীকালে জন্মগ্রহণকারী এই কবিরাই নিকট ভবিষ্যতে হবেন দেশের প্রধান কবি এবং এগিয়ে নেবেন বাংলাকবিতাকে।
বাংলা কবিতার এই তারুণ্যখচিত প্রজন্মের চোখে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে বসে আমি একেকটি কবিতা পড়ি আর অবাক হই, তাদের দেশ—সমাজ—ইতিহাস আর রাজনীতি সম্পর্কিত সচেতনতা আর প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি দেখে বিস্মিত হই! বঙ্গবন্ধুকে তারা দেখেননি, জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁকে হত্যা—ট্রাজেডির অনেক পরে। অথচ কী নিবিড়ভাবে তারা জানতে চেষ্টা করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে! কারো কারো কবিতায় প্রত্যক্ষ করেছি বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আর ‘কারাগারের রোজনামচা’ পাঠের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত উপলব্ধিও। একটি কবিতায় বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনার ছায়াপাতও প্রত্যক্ষ করে মুগ্ধ হয়েছি। তরুণ প্রজন্মের কবিরা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় আর অবিস্মরণীয় ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর তার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক সচেতন, চিন্তাচেতনায় তারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের আদর্শে বিশ্বাসী। এ প্রসঙ্গে তাদের আশ্বস্ত করতে চাই, যারা ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ‘ধর্মহীনতা’ মনে করে আজও বিভ্রান্ত— ধর্মান্ধতাকে ঘৃণা করাই অসাম্প্রদায়িকতা। ধর্মানুরাগ সর্বদাই কাক্সিক্ষত, অন্তত আমার কছে। ধর্মের সঙ্গে প্রগতির বিরোধ নেই। বিরোধটা সাম্প্রদায়িকতায়। এই সংকলনভুক্ত তরুণ প্রজন্মের কবিদের অধিকাংশের মধ্যে আমি সেই সচেতনতা লক্ষ করেছি।
এই সংকলনের কবিতাগুলোর মধ্যে বেশ কিছু কবিতা রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ আর রাজনৈতিক জীবনের উজ্জ্বল দিক নিয়ে। যেখানে তরুণ কবিরা মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় দেশপ্রেম, সাহস, সততা আর মানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গির। একাধিক কবি এ ধরনের ভাষ্য তুলে এনেছেন তাদের কবিতায়— আমি তোমাকে দেখিনি কোনোদিন তবু তুমি সবচেয়ে প্রিয়মুখ আমার। কেউ লিখছেন— তুমি তো মানুষের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি অনন্ত বিদ্যুৎ। তোমার স্বপ্নে আজো ভোর হয়, পাখিদের কলতানে, এই জন্মভূমির তুমিই প্রেরণা… তুমি আমাদের বাঁচার স্বপ্ন দেখাও। একাধিক কবি নুহ নবীর কিশতি বিষয়ক মিথ ব্যবহার করে বোঝাতে চেয়েছেন কীভাবে চরম বিপর্যয় থেকে বাঙালি জাতিকে উদ্ধারের জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের নৌকায় তুলে নিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। মুজিব কী? তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যখন কোনো তরুণ কবি লেখেন— মুজিব মানে মহাপ্লাবনের নুহের নৌকা সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশ্রয়/মহাসমুদ্রের বুকে একখণ্ড সবুজ। …বঙ্গবন্ধু কোনো নাম নয়, দেশ নয়— উচ্চারিত ভাষা, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল মুক্তির সম্ভাবনা প্রিয় ডাকনাম। কেউ লিখছেন— শুধু জানি তুমি অবিনশ্বর, অনন্তকাল জ¦লা নক্ষত্র আগুনঝরা সূর্যপ্রাণ এক। কল্পিত সংলাপে কোনো কবি শুনতে পান একজন পিতা কোনদিকে যাচ্ছেন পুত্র জানতে চাইলে পিতা উত্তর দেন: ভোরের দিকে। এই ভোর প্রতীকী এবং আজকের বিভক্ত বাংলাদেশে অন্ধকারের বাইরে যেতে সবারই কাম্য। সেই প্রত্যয় আরও দৃঢ়তা পায় যখন তরুণ কবি লেখেন– তুমি মিশে আছো পদ্মার ঢেউয়ে/পাকা ধানের সোনালি হাসিতে/ঘরে ফিরতে চাওয়া ক্লান্ত পাখির ডানায়/কোটি বাঙালির আত্মায়, উচ্চারণে।
এমন এক বৈরী সময়ে এই কাব্য—সংকলন বেরোচ্ছে– যখন গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের নামে নতুন করে মৌলবাদী পাকিস্তানি অন্ধকার বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ করছে। ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ শুধু রাবণের লঙ্কাতেই ছিল না, এখনো আছে, এই বঙ্গদেশে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও অন্ধকার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল এদেশে। আজ যখন ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার’—এর নামে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন এই সংকলনভুক্ত কবিদের কণ্ঠে শুনি– এই জন্মভূমির তুমিই দর্পণ’, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, কী গভীর ভালোবাসার বন্ধনে তারা বেঁধেছেন স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে! দেশের সবচেয়ে সচেতন তরুণ অর্থাৎ একালের তরুণ কবিরা যখন বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুধাবন করতে সক্ষম, তখন কোনো অন্ধকারই এদেশে যে শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হবে না– এ বিশ্বাস করতেই পারি।
সংকলনভুক্ত কবিতামালায় বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ তথা মানবতাবাদী দর্শন তরুণ কবিদের চেতনায় দারুণ প্রভাব ফেলেছে। কোনো কোনো কবিতায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে মানবপ্রীতির অনুভব জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তারা তাই উপলব্ধি করেন– মৃত্যুর মধ্যেই যেন ফিরে পাই অনন্ত জীবন…। হত্যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতা মুছে যান না। পনের আগস্টের শোক তারা হৃদয়ে ধারণ করেন বলেই লিখতে পারেন— পিতা তুমি ডাকলে বলেই না আমরা জেগেছিলাম…। ১৫ আগস্ট সবুজ নক্ষত্রের ভেঙে—পড়া রাত। এমন কঙ্কাল সময় আমি কখনো দেখিনি…। বঙ্গবন্ধুর দর্শন জানেন বলেই তারা উচ্চারণ করতে পারেন— পিতারা মরে না, বেড়ে ওঠে সন্তানের মননে…। শহিদ মিনারে আমাদের যৌথ সমাপনী/তাদের অন্তর্লোকে নীরবে উচ্চারিত নাম/শেখ মুজিবুর রহমান। আর তাই আজও ‘এই বাংলার অদীক্ষিত মানুষ ছুটে আসে, আসতে থাকে বত্রিশ নম্বরে, শিকড়ে, উৎসে।’ বঙ্গবন্ধু—দর্শনের প্রত্যয় দৃঢ়তর হলেই গভীর ভালোবাসায় ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর আঙুল নিয়ে লেখা যায়— ওই তর্জনী মহাকালব্যাপী চিরন্তন এক সৌধ এখন। কিংবা তোমার তর্জনী জ¦লে দেশনার ঔজ্জ্বল্যে। কিংবা ঘ্রাণেরা গুঞ্জন করে, বিস্মিত হয়। গোলাপ এগিয়ে/এসে পরিচয় করিয়ে দেয়, তিনি আর কেউ নন/ আমাদের সবার পুষ্পপিতা। অথবা পনের আগস্ট বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষুব্ধ তরুণ যখন উচ্চারণ করেন— কার জন্য তুলেছিলে আঙুল বৃথাই প্রিয়!/কার পায়ের তলায় ছড়িয়ে দিয়েছিলে/তোমার অমল আকাশ?/ পিতা,/ কার জন্য! —তখন সেই ক্ষুব্ধ প্রশ্ন সমগ্র জাতির উচ্চারণ হয়ে ওঠে যেন!
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, শোকের দিন ১৫ই আগস্ট অনেকের কবিতার উপজীব্য হয়েছে এই কাব্যসংকলনে। বঙ্গবন্ধুর বিশালত্ব বোঝাতে আবেগ থরোথরো দুটি পঙক্তি উচ্চারণ করি– ‘হে জনক, ভর করো আমার তর্জনীর ওপর/ আমিও হুংকারে বলি: আমি মুজিবের সন্তান।’ এই তরুণরা আজও বিশ্বাস করেন– পনেরই আগস্ট কোনো দুর্ঘটনা নয়।’ এ হচ্ছে গভীর ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু আজ আর কোনো নাম নয়, একটি বিশাল মানচিত্র, একটি অনির্বাণ চেতনা। কিংবা দুই লাইনের কবিতায় কী বিশাল ব্যাপ্তি! যতদূর যাও পাখি দেখা হবে ফের/ স্বাধীন ওই আকাশটা শেখ মুজিবের।
এই সংকলনের সব কবিতাই যে শিল্পনৈপুণ্যে সার্থক, তা বলবো না। কিন্তু কবিদের অন্তরের যে আবেগ, তার মূল্য এতটুকু কম নয়। তাই তো তারা অবলীলায় বলতে পারেন— তুমি তো উপমার শ্রেষ্ঠ উদ্বোধন। তোমার আঙুলের ইশারা যেদিন থেমে গেছে বুলেটের আঘাতে/সেদিন থেকেই ঘাসবিচালিতে ভরে গেছে বাংলার কচি ধানখেত। বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্ব বোঝাতে গিয়ে তাই লিখতে হয়— ভাস্কর্যও আর কতটুকু ধরতে পারে এমন ব্যক্তিত্ব! বন্দুকের সামনে তুমি গর্জে ওঠা আরেক বন্দুক। অথবা একমাত্র সুলতান তুমি বৃহৎ বঙ্গের– এমন উচ্চারণে কবির যে গভীর শ্রদ্ধাবোধ– সত্যিই তা ব্যাখ্যাতীত। যখন এমন উচ্চারণ শুনি– আমাতে বিভোর হও, আমিই শেখাব তোমায় শেকড়ের গান/কেননা আমিই রক্তবীজ, মুকুট পরেছি হৃদয়পিতার।
১০৪জন কবির কেউবা ছড়ার ছন্দে, কেউবা গদ্যে, কেউ সনেটে, কেউবা গানের আঙ্গিকে চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে। ৭ই মার্চকে যখন একজন তরুণ কবি দেখেন– ‘অপমানিত গণমানসে জ্বলে ওঠা প্রথম হোমাগ্নি’ হিসেবে– ‘এমন দাউ দাউ রেসকোর্স আগে কখনো কেউ দেখেনি’– তখন মুগ্ধতায় মন ভরে যায়। সনেটের আঙ্গিকে ‘রেসকোর্সের ঘটনাবলি’ বিশুদ্ধ মাত্রাবৃত্তে পড়তে পড়তে কোনো কোনো কবির দক্ষতায়ও পাঠক মুগ্ধ হবেন। এককথায় নির্দ্বিধ—চিত্তে উচ্চারণ করা যায়, এই নিবেদিত কাব্য—সংকলন চিরবহমান এমন এক কাব্যধারা, যা ইতিহাসের মতোই চিরজাগরূক।
1 thought on “তারুণ্যের উচ্চারণে চিরকালের বঙ্গবন্ধু | নাসির আহমেদ”
জয় বাংলা