আমি যখন কবিতা লেখা শুরু করি, তখন লেখাজোখার আদ্যোপান্ত সকল নিয়মকানুন জেনে নিয়েই কবিতা লিখতে বসেছি, ব্যাপারটি তেমন নয়। কবিতা তো একধরনের ওহি বা কল্পনা ও ঘোরলাগা মায়াজালস্বপ্নের স্বতঃই বৃষ্টি। যা স্বয়মাগত। যার কোনো ইস্কুল নেই, টোল বা কারখানা নেই। কবিতা আপনাতেই হয়ে ওঠে কবির নিয়ত স্বয়ম্ভু এক ব্রতচারী পরিমণ্ডলে। কবির সজাগ সত্তার আপন প্রেষণাই কবিকে দুর্মর পঙক্তি-সকলের উদ্দ্গাতা করে তোলে। তবু কিছু বিষয় থাকে, কিছু রীতি ও রূপরেখা থাকে, যা একজন কবির উচ্চারণকে, একজন সৃষ্টিশীলের ওঙ্কারধ্বনিকে পরিমার্জিত ও উচ্চারণসিদ্ধ প্রত্যয়ে অধিষ্ঠিত করে তোলে। আমার বেড়ে ওঠা সময়ে কিংবা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়, বাংলা ভাষার প্রায় সকল কবির বেড়ে ওঠার কালে আমি/আমরা এমন কিছু বইয়ের সহযোগিতা পেয়েছি, যেগুলো আমাদের কবিসত্তার ভেতরজগতকে প্রণোদনা দিয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘ছন্দ’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’, ‘কবিতার কী ও কেন’ শঙ্খ ঘোষের ‘ছন্দের বারান্দা’ প্রভৃতি। এই কটি বই আমাদের কবিতা-শৈশবকে উসকে দিয়েছে কবিতার দুর্বার আগুনে হাত পাততে। পরবর্তীকালে এই বিষয়ে আরও অনেকের অনেক বইপত্র বের হয়েছে কিন্তু পূর্বোক্তগুলো সবিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বেশি।
আনন্দের কথা হচ্ছে, কবি কামাল চৌধুরী কবিতা লেখার করণকৌশল ও সাধারণ নিয়মবিধি নিয়ে সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন, যার প্রকাশনা উৎসব হয়ে গেল গত ২৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। ‘কবিতার অন্বেষণ কবিতার কৌশল’ শীর্ষক শিরোনামের বইটি এখন আমার লেখার টেবিলে। বইয়ের শুরুতেই তিনি আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘এ কোনো গুরুভার লেখা নয়, কোনো তত্ত্বকথাও নয়। কবিতার কোনো পাঠশালা নেই, মানবজীবনই কবিতার পাঠশালা। কবিতা লেখা শেখানো যায় না। কিন্তু যা শেখানো যায় না, তাকে শিখে নিতে হয়। কবিতা লেখাও শিখে নিতে হয় কবিকে। এই বোধ ও উপলব্ধি থেকেই এই লেখাগুলির অবতারণা।’
কবি কামাল চৌধুরীর নিজস্ব এক পরিণত কাব্যবোধ ও শব্দদর্শন রয়েছে। তার পরিমিত কাব্যাভিজ্ঞতা ও প্রতিনিয়তের চর্চা ও অনুশীলনের আশ্চর্য সাক্ষর রয়েছে এই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। কবিতা কীভাবে লিখতে হয়, কোনটা কবিতা কোনটা কবিতা নয় বা কবিতা কীভাবে হয়ে ওঠে, কোনটা পদ্য কোনটা ছড়া কোনটা পয়ার বা লিরিক, কোনটা কোন বৃত্তকলার, কোনটা এসব কিছু না হয়েও কীভাবে মুক্তছন্দে কবির স্বগতোক্তি হয়ে ওঠে- ইত্যাকার বিষয়ে লব্ধপ্রতিষ্ঠিত কলম নিয়ে একজন প্রাতিষ্ঠনিকের মতোই কিন্তু সহজ ও নির্ভার আঙ্গিকে তিনি তার সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা ও পঠনপাঠনের ঝাঁপি খুলে দিয়েছেন আধুনিক পাঠকের সমীপে।
মোট আটটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই বইয়ের শাখা অনুচ্ছেদে তিনি সুবিস্তৃত আলোচনা করেছেন কবিতার ভাষাস্থাপত্যের নানা কৃৎকৌশলের গঠনপ্রণালি, উৎকর্ষ ও চারু-নির্মিতি নিয়ে। এর প্রতিটি আলোচনাই স্বাদুগদ্যে টইটম্বুর। কী বর্ণনায়, কী রেফেরেন্সে, কী উপমায় কবিতালেখার নানা পর্ব-পর্বান্তর নিয়ে মকশো করার ভঙ্গিতে তিনি পাঠককে নিয়ে যান অন্য এক কল্পলোকে। বইটি আমাদের সাহিত্যসৃষ্টি তথা কবিতানির্মাণকলার একটি গঠনমূলক অনবদ্য গ্রন্থ হিসেবে প্রতিদিন প্রতিটি আন্তরিক উচ্চারণের পরিচর্যার সঙ্গী হয়ে ওঠার যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হয়েছে। আমি বইটিকে আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার এবং তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অবশ্যপাঠ্য সহায়কগ্রন্থ হিসেবে সিলেবাসভুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সমীপে বিনীত অনুরোধ জানিয়ে রাখলাম।
২
কবিতা, যার অপর নাম পোয়েট্রি বা শায়েরি, সে তো ওহি। নাজেল হয় অন্য আসমান থেকে। যে আসমান দূরাতীত কোনো অনধিগম্য স্পেস নয়, কোনো মহাকাশ-চারীর দূরপ্লাবী কোনো চাঁদমারি নয়, নয় কোনো শব্দহীন স্পর্শহীন ঘ্রাণহীন প্রাণহীন নিথর কোনো অলীক প্রপঞ্চ।
কবিতার আসমান স্বয়ং কবির সহৃদয় এক হৃদয়-ভূমি। যেখানে ওহির ফেরেশতারা নিত্য আনাগোনা করে চিরনতুন বার্তা নিয়ে। কাল যার দিব্য পরিত্রাণ। মাটি যেখানে সুফলা উর্বরা। রক্ত সেখানে সতেজ স্বয়ম্বরা। প্রাণ সেখানে বিস্রস্ত উন্মনা। কখনো সখনো ভূতগ্রস্ত কোনো বেনামি বা মরমি জীবকোষের অস্তিত্বের আশকারা সকল যেখানে এসে তাবৎ খুনশুটি খেলে যায় আচম্বিতে, নিদারুণ কোনো প্রেষণে কিংবা উচ্চমান সোহমে।
কবিতার বিজ্ঞান তাই একটি ময়না, প্রধাবিত এক চলিষ্ণু তদন্তের জীবন্ত ময়না। নিত্য অনিবার্য ও আবিষ্কারময় স্বাধীন ও মুক্তখনির নিশ্চিত আয়না। সে পাখিটি পয়গামবাহী প্রাচীন কোনো স্পর্ধিত খুলির অথবা স্বয়ংসিদ্ধ প্রাণবাণীর। যেখানে মানুষমাত্রই এক স্বয়ম্ভু ঈশ্বর অথবা ঈশ্বরের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবুদ্ধ কোনো অগ্নিসত্তা। যে জ্বলে ও জ্বালায়। পোড়ে ও পোড়ায়। দহে ও দন্ধীভূত করে সমুদয় সৌন্দর্যের আকুল আনাজ। নৃত্যমুদ্রার ছন্দিত কারুকাজ।
একজন প্রকৃত কবি তাই তার কালের যোগ্যতম সাহসী প্রতিভূ। যিনি একটি জাতির আকাঙ্ক্ষার রঁদেভু। যিনি একটি রাষ্ট্রের খোলনলচে পালটে দিতে পারেন কবিতার কিমাশ্চর্যম কিমিয়া দিয়ে।
৩
কবি কামাল চৌধুরীর কবিতার উজ্জ্বল ভুবনে নতুন করে চকিতে টু মেরে উপর্যুক্ত উপক্রমটি অনুভূত হলো আমার আশ্চর্য জার্নিতে, অনেকটা স্বকৃত সংশ্লেষে, বিমুগ্ধ বোধে ও স্বয়ম্মহিমায়। কামাল চৌধুরী কবিতা লেখেন না, কেউ যেন ঘোর কাপালিকের মতো তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেন আজব সব পঙক্তিমালা পরাক্রান্ত কায়দায়। কবিতা লিখতে যে সচেতন সত্তাটির সমগ্র নিমজ্জন প্রয়োজন, সে মনোপূর্ণিমার মোক্ষম প্রহরটি যেন তিনি পেয়ে গেছেন এদেশের স্বাধীনতায়, ঐতিহ্যে, এখানকার জলবায়ু নিসর্গের আলোভরা জোছনায়, এদেশের মাটি ও মানুষের কৃষ্টিজাত ঐশ্বর্যে ও হৃদয়চেরা বীরত্বে। তাই কি তার উচ্চারণ এমন শোভামণ্ডিত সরণিতে এসে আমাদের ঝাঁকিয়ে তোলে:
এই দেশে আমি আছি রক্তভেজা এই জনপদে
সহস্র মৃত্যুর সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হয়ে যায়
তবু আমি ভয়হীন দীপ্র-বর্ণ অনার্য যুবক
অনায়াসে ছিন্ন করি হাতকড়া, আঁধার নীলিমা
নিসর্গ আমাকে চেনে, চক্ষুষ্মান মানুষ চেনে না
মানুষ দেখেনি আজো পরাক্রম বাহুর ক্ষমতা
শব্দে শব্দে গড়ে তুলি অলৌকিক নদী ও প্রাসাদ
সবুজ শস্যের গ্রাম, তীব্র ক্ষিপ্র কবির কবিতা।
আমার প্রাসাদে এসো, অনুরোধ ফিরে যাবে জানি
তবু আমি দিয়ে যাবো সুবর্ণ আমার আমন্ত্রণ
গ্রামগঞ্জ লোকালয় মনে রেখো আমার ঠিকানা।
আমাকে বিশ্বাস করো, অবিশ্বাসী হয়ো না কখনো
আমার ভেতরে জেনো বাস করে লালন ফকির
প্রতিদিন যাকে দেখি সেই আমি আমাকে চিনি না?
কবি কামাল চৌধুরীর উপরিউক্ত ‘রক্তাক্ত পঙক্তিমালা’ আমাকে রক্তাক্ত করে উপলব্ধির কোরাসে নিত্য নতুন প্রশ্নে ও দ্বন্দ্বজর্জর মুখোশে। এদেশের জন্মসত্তা, এদেশের প্রত্যাশা, মুক্তিযুদ্ধ, এদেশের একুশ, বিজয় পতাকা, সাম্যগান, এদেশের ধান-দূর্বাঘাস, শ্রমসিদ্ধি, এদেশের চির হরিৎ প্রণয়- কারা লুট করে নিয়ে যেতে চায়? কারা আমাদের মিছিলের বিপরীতে গিয়ে সিঁধ কাটে? তারা কি আজও বেঁচে আছে? জাতিগত অস্তিত্বের এমন প্রবল টানাপোড়েনের মুখে দায়শীল কবি, স্বাধিকার চেতনার কবি, পরাক্রান্ত বীর্যবত্তার কবি প্রবল বিদ্রোহে ফুঁসে ওঠে জ্বলে ওঠে চিঠি লেখেন অনাগত প্রজন্মের দুয়ারে- ‘তুমি পড়বে না জানি, তবু এই চিঠিখানি পাঠিয়ে দিলাম।’
8
কবি এক সার্বভৌম প্রাণী এবং তিনি সর্বভুকও এবং চির প্রতিরোধীও- যিনি নিজস্বতার আখরে বুনে যান চিরগৌরবের কাসিদা। যার প্রার্থনা, যার শৈশব, যার শর্বরী ও সরোদ, যার সময়স্রোত ও অস্থির একাঙ্কিকা মেলে ধরে নিপাট রূপের উজ্জীবনা। তাই কি, কবি যখন একটি চিত্রদৃশ্যের জন্য প্রহরের পর প্রহর কাটিয়ে দেন শিশিরের স্নিগ্ধভূমে, মেঘে বিদ্যুতে, শ্লোগানে মিছিলে, বারুদে রাইফেলে, স্বদেশের যুদ্ধে- তখন তার আনত সঙ্গত মুখখানি বড়ো মধুর, বড়ো পবিত্র, সফেদ ও কবিতাময় হয়ে ওঠে। কবি কামাল চৌধুরীর কবিতান্বেষা তাই একটি প্রাগৈতিহাসিক আত্মজাতির জাগৃতির অন্বেষা। তাই আমার কাছে তার কবিতা যতটা না রাজনৈতিক, তারচেয়ে অনেক বেশি প্রাণজাত আর্তস্ফূর্তির ও প্রত্নময় উদ্ভাবনীর। প্রাচীন কোনো গ্রিক বীরের মতো যিনি গেয়ে যান স্বভূমির প্রকর্ষ যত কল্যাণী, নিজের অনার্য বংশগাথা, নিজের মা-মাটি-মানুষের শৌর্যোক্তি, নিজের উদার স্থাপত্য ও মহান স্থপতির তরফে অমেয় শোকস্তব্ধ প্রতিশোধের স্তোত্রমালা এই বাউল বাংলার পথে-প্রান্তরে জলেস্থলেঅন্তরিক্ষে। কী বিধুর তার উচ্চারণ:
কবরের নির্জর প্রবাসে
তোমার আত্মার মাগফেরাতের জন্যে
বৃদ্ধেরা কাঁদে
হে আমার স্বাধীনতার মহান স্থপতি
মহান প্রভুর নামে আমার শপথ
সেই বৃদ্ধদের প্রতি আমার শপথ
সেইসব ভাইবোন লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতি আমার শপথ
আমি প্রতিশোধ নেবো
আমার রক্ত ও শ্রম দিয়ে
এই বিশ্বের মাটি ও মানুষের দেখা
সবচেয়ে মর্মস্পর্শী জঘন্য হত্যার আমি প্রতিশোধ নেবো।
[টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে]
পৃথিবীর সবচেয়ে সফল স্বতঃস্ফূর্ত জননন্দিত ক্ষণজীবী মহানায়কের নির্মম নৃশংস সবংশ হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে এর চেয়ে বীর্যবন্ত শক্তিশালী সাহসী উচ্চারণ আর কোথায় কোন মহাকাব্যে রচিত হয়েছে আমার জানা নেই।
৫
কবি কামাল চৌধুরী আমাদের কালের দ্রোহের কবি, প্রতিরোধের কবি, সচেতনা, সাহস ও সংগ্রামের কবি এবং আধুনিক বাংলা ভাষার একজন তুখোড় নন্দনরসের প্রাজ্ঞ শ্রীমান কবিও তিনি। তার কবিতা যেমন স্মৃতিস্মর, সহসা সচকিতের উন্মোচক, দীপালির মতো জ্বলজ্বলে কিন্তু উচ্ছল ও উন্মুখর, তেমনি তার পদাবলি কান্তিমান স্বপ্নাতুর মাধুর্যমণ্ডিত হার্দ্য কোনো সাঁটলিপি যেন। গলে গলে যায় পরিমিত পাহারায়। আমার এ বক্তব্যের সপক্ষে আমি হালের কবিতার নান্দনিক পাঠকদের সমীপে তার অনেক আগে লেখা ‘শব্দ’ কবিতাটি পুনর্বার পাঠ করতে পরামর্শ দেবো। আমার এ পরামর্শ কোনো পাঠককে বিফলে ফেরাবে না আশা করি। অদ্ভুত এক মাদকতাসঞ্চারী ঝংকৃত কিন্তু অভিমণ্ডিত একটি নির্ভার প্রার্থিত কবিতা এটি। শব্দ জাদু রাখে, স্বপ্নকে জোছনা দেখায়, শব্দের শাখায় ছায়ায় কীভাবে অতীতেরা ঝুলে থাকে, কথা কয় বড়ো নমিত নমস্য ভঙ্গিমায় অথচ সটান মর্মরে সেই মানুষ পুনর্বার বেঁকে ওঠে আপন অভিসারে, লীলাবতী গরিমায় ক্ষোভে ও বিদ্রূপেও। সংক্ষুব্ধ সত্তার আশ্চর্য প্রাণবন্ত সংলাপে বিচিত্র বিভাময়ী একটি কবিতা। জয়তু ‘শব্দ’।
৬
কবি কামাল চৌধুরী শুরু থেকেই সতর্ক চৌকান্নায় ধীর পদবিক্ষেপে বেছে-খুঁড়ে অতি সন্তর্পণে কবিতার উর্বর মাটিতে পা ফেলে আসছেন, সেটা বোঝা যায় তার সামষ্টিক কাব্যপরিক্রমায়। কবিতা একটি নিভৃতি ও সযত্নের বিষয়, সাধনা ও পরিচর্যার আশয়, মহাকালের মার্গে মার্গে যার মাইন পোঁতা, সেই বিপদসংকুল শ্বাপদারণ্যে নিজেকে প্রকৃত যোদ্ধা হয়ে তবে লড়তে হয় বা পথ অতিক্রম করতে হয়, সেটা অনুধাবন করা যায় কামাল চৌধুরীর কবিতার আলে আলে, কবিতাজমির প্রতিটি নিড়ানিতে, শস্যের বুননে ও উপলব্ধির অবগাহনে।
আমাদের কালে কবি কামাল চৌধুরী তার যাপিত-সময়কে উজ্জ্বলরূপে ধারণ করতে পেরেছেন কবিতায়, অক্ষরের প্রতিচিত্রে, উপমায় ও সহজ অভীপ্সায়। ঐতিহ্যের সংগ্রাহী, সমকালের সমঝদার, ভবিতব্যের রাজকুমার কবি কামাল চৌধুরীকে তাই আমরা দেখতে পাই সমস্বরে, নির্জনে, ধ্যানের গুহায়, ভূর্জপত্রের গাত্ররেখায় বিচিত্র বিম্বিত প্রতিবিন্যাসে, গ্রামবাংলার নন্দনভূমির পলিপল্লবগ্রাহিতায়।
বাঙালির ইতিহাসের সবচাইতে বড় অর্জন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের যে প্রতিকূল চেহারা, যে অস্থির ও বিপন্ন বিস্ময়বোধ, তা তার কবিতায় প্রতিমূর্তি পেয়েছে বহুমাত্রিক অভিনিবেশনায়। তাই তার উক্তি ও উপলব্ধির ভিন্নতা, দ্রোহ ও স্বপ্নভঙ্গের মনোবেদনা, ব্যতিক্রমী বাকভঙ্গি ও ছন্দকুশলতা তার কবিতাকে দিয়েছে সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য অভিজ্ঞান। বাংলা কবিতায় তার পরিশুদ্ধ ভূমিকা তাই এখন আরও প্রত্যক্ষ ও সুষ্পষ্ট। যেখানে স্মৃতিরা তার হাতে নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠে। বেদনা পায় অতলান্তের পরিভাষা। প্রেম পায় পরিদ্রুত বাঁধন। দ্রোহ সেখানে তার শিরস্ত্রাণ। দেশপ্রেম তার প্রপূর্ণ বিভূতি। বাংলার জীবনাচার তার অনবদ্য আততি। রক্তে তার বীর্যবিধান, অভেদ্য ও অপ্রতিরোধ্য- তাই আজ শাশ্বত বাংলার চির অপরাজেয় কবি তিনি।
৭
কামাল চৌধুরী তার কাব্যোচ্চারণে সবসময় মিতব্যয়ী, স্বল্পাঙ্গিকী, ছন্দ ও স্বপ্নের যুগস্বরে অভিযাত্রিক ঘোরে অন্য কোনো ব্যঞ্জনা চারিয়ে দিতে উদগ্রীব, যা আমাদের প্রতিতুলনার বিশ্বে ও জাগতিক কল্পনায় নানা বিভাস, নানা প্রতিভাসের জন্ম দেয়। সেখানে তিনি যখন মেঘ শব্দটি উচ্চারণ করেন অথবা ধূলি, চাঁদ, উল্কাপথ, উল্কি, একতারা অথবা অন্যকোনো ললিত বা নৃশংস সমারূঢ় উপমা, তখন সেগুলো নিছক আটপৌরে শব্দের খোলসে আবদ্ধ থাকে না। শব্দকে শব্দাতীত, উচ্চারণকে ব্যঞ্জিত, উপলব্ধিকে উন্মথিত, উপমাকে অভিমণ্ডিত, তথ্যপ্রবাহকে গতিবান, মনোভঙ্গিকে প্রাতিস্বিক ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করে তুলতে তাই তার কবিতার জুড়ি নেই। শ্লেষেও তিনি সমান উদ্বাহু সুরম্য ও সূক্ষ্ম সুতীক্ষ্ণ। তিনি যখন লেখেন:
এইসব তত্ত্বজ্ঞান, চতুর্ভুজ খেলা আর
ইজমের গোলক ধাঁধার মধ্যে সরল কবিতা যখন হাবুডুবু খায়
তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না কবির চেয়ে অধ্যাপকই জ্ঞানী
তুমি শিখে নাও, হে পাঠিকা কালবিলম্ব না করে এইসব টেকনিক শিখে নাও
তুমিও বুঝতে পারবে, ছন্দজ্ঞান ঝুলে পড়লে ছিদ্র অন্বেষণ করতে পারবে
সহজেই
দেখতে পাবে তোমার প্রশংসার কাছে কতটা বিনীত অক্ষরের প্রভুগণ…
[মেঘ ও ধূলি সম্পর্কের কবিতা]
কবিতার বাইরে যে বিশ্ব বা যত পরিমণ্ডল আছে বা থাকতে পারে, সব তার কাছে মূলত গৌণ, গৌণতর। তিনি স্বতঃই উচ্চারণ করেন, ‘বিরহের আখ্যানকাব্য রচনা করার জন্য আমার এই বাউলজন্ম’, অথবা ‘তোমার উন্মাদ জলে আমি অক্ষরের গতিসূত্র লিখি’, অথবা ‘… জন্মে জন্মে কবি সিসিফাস/পাথর সরিয়ে তাকে পেতে হবে ভোরের আকাশ’, অথবা ‘ভালোবেসে নিঃস্ব যারা তাদের খাতায়/এই বোকা লোকটিও নাম লিখিয়েছে।’
৮
২০২০ সালে প্রকাশিত বিদ্যাপ্রকাশের পরিমার্জিত সংস্করণে তার কবিতাসংগ্রহে অন্তর্ভুত ১১টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে যে কবিতাগুলো কবি কামাল চৌধুরীকে সম্পূর্ণ নিজস্বতার পরিচয়ে শনাক্ত করে, এখানে আমি তার একটি ছোট্ট তালিকা উপস্থাপন করছি (উল্লেখ্য, এটা আমারই একান্ত নির্বাচিত), যেখানে বাংলাভাষী পাঠকমাত্রই অনুধাবন করতে পারবেন কবিতার মরুময় দুস্তর প্রান্তরে তিনি কতটা স্বতঃস্ফূর্ত, কতটা দ্রোহী, কতটা প্রেমিক, অনিবার্য, শৈল্পিক ও সারবান নীলকণ্ঠী।
মিছিলের সমান বয়সী: জন্মের প্রার্থনা, জন্মের কবিতা, ক্রাচের যুবক, পদচিহ্ন, নিসর্গকুমারী, রক্তাক্ত পঙক্তিমালা, সেই মুখখানি কবিতার বড়ো ছিল, উষ্ণতা চাই তার দুই হাতে, টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে, অলৌকিক মানুষের গল্প, খরা।
টানাপোড়েনের দিন: মুক্তি ও বিপ্লব-এর কবিতা, বয়স পঁচিশের গল্প, নিরুত্তর শব্দবাক্য, তোর জন্য নাম, রুদ্র কোথায় খুঁজব আমি, রবীন্দ্রনাথ-এর উদ্দেশ্যে, নজরুল-এর উদ্দেশ্যে, যমজ।
এই পথ এই কোলাহল: রুদ্র তোর স্মৃতি, আমার আনন্দ, প্রকাশ্য শরীর থাকে, গোলাপের সাথে দেখা হবে, প্রবেশ নিষেধ, শব্দ, হাসান হাফিজুর রহমান, যমদূত, আজ কবিতার ছুটি, মানুষ, আয় সূর্য।
এসেছি নিজের ভোরে: এসেছি নিজের ভোরে, আমাকে জন্ম দাও ভিন্ন কোনোভাবে, পান্থশালা কোন বনভূমি, কবির রাত্রি, পালক, আমাদের চতুর্দশ সালে, শহিদ জননী, কাপালিক, অঙ্কুর, বৈপরীত্য, চূড়া।
এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা উৎসর্গ পত্র, প্রাতঃভ্রমণ, দেয়াল জিজ্ঞাসা, প্রথম পাঠ, বাঁধন, কবিকেও যেতে হয়, মুক্তিযোদ্ধা, আজ ফিরে পেতে এসেছি প্রবেশাধিকার, ভ্রমণ কাহিনি।
ধূলি ও সাগর দৃশ্য: সবুজ মদিরা, হাড়ের গল্প, সেতু ও বিরহ, পথের কবি বিরহ যেন শেখে, তোমাদের প্রেমের যাত্রা শুরু হোক, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, শোকগাথা: পিতার জন্য, সাহসী জননী বাংলা, কবিকে অচেনা রেখে, বালক পথে কবির পথে, সকলেই যোদ্ধা নয়, কায়রো ডায়েরি, একটি নিষ্কাম কবিতা, মেঘ ও ধূলি সম্পর্কের কবিতা।
রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল: অপার্থিব, জন্মদিনে, অনিঃশেষ, বৃক্ষ, কবিতা নিখিল, পতাকা, অভয় মিনার, কবিতাংশ, যুগলবন্দি, পাখিকে পাঠাই পত্র, ক্যাপ্টেন জেমস কুকের উদ্দেশে, শাশুড়ি মা-কে।
হে মাটি পৃথিবীপুত্র: সংশপ্তক, হে মাটি পৃথিবীপুত্র, স্রোতের গল্প, বিজ্ঞাপন, লুনার রিয়েলিটি, ভ্রমরের মৃত্যুলেখা, ভাগ্যিস সমুদ্র গুপ্ত, পথের কবিতা, কবির পথ, ফুটপাত কাহিনি, পুরাতন খেলা, দৃষ্টি, জীবনী অংশত বৃষ্টি, প্রত্নতত্ত্ব, যুদ্ধশিশু।
পান্থশালার ঘোড়া: রূপকথা, ধীবরকালের নৃতত্ত্ব, কারণ আমরা ফিরছি, নাপিত সমাজ, এই দেশ তাঁতিপাড়া থেকে দূরে নয়, ফুটনোটে বসন্ত, ছায়া, অধ্যাস, ভূতের গল্প, নদী বিমুখ করে না, ফেরা, নতুন কবিতার জন্য।
উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা: উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষ্য, শেষরাতের ট্রেন, অতল, আরাধ্য, শিলালিপি, শূন্যদশক, শ্রমজীবী, ফুলের দোকান থেকে, করতাল, সূর্য ডোবার স্মৃতিকথা, এসো দিগন্ত এসো কবিতা, নির্জন গ্রন্থাগার, বিজয় দিবস, মাছাইমারা, মার্চ, তোমার অক্ষর।
অন্যমনষ্ক অনুপ্রাস: বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়ি, সমঝোতা, এসো জেগে উঠি, প্রতিশ্রুতি, প্যারিস, তুষারপাত ৪, তুষার হৃদয়, বাঙালির সম্মান, মাতৃভাষা, শামসুর রাহমান স্মরণে, ঘাসের নিচে শুয়ে আছেন সৈয়দ হক, এই যে আমি, কন্যার জন্য কবিতা, কবিতা আমার ভাষা।
৯
২০০৭ সালে কবি কামাল চৌধুরী যখন পঞ্চাশে উত্তীর্ণ, তখন তিনি উপসচিব পদমর্যাদায় শেরপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঐ সময় তার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে লোক-এর পক্ষ থেকে তার পঞ্চাশ উদযাপন এবং ‘কবির ৫০: কামাল চৌধুরী’ শিরোনামে লোক-এর একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিলাম আমরা। এবং সেই উদযাপন ও সংখ্যাটি ছিল কোনো বৃহত্তর পরিসরে তার প্রতি বাংলাদেশের কবি-প্রজন্মের প্রথম শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। এরপর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা পদে সমাসীন হয়েও তিনি সম্পূর্ণ পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে যেভাবে নির্মোহ ও সাত্ত্বিক সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন, তা আজ আমাদের সকলের জন্য এক অনন্য উদাহরণ। আজ আমরা গৌরবের সঙ্গে বলতে পারি, লোক-এর পক্ষ থেকে সেই সময় তার সাহিত্যিক মূল্যায়ন ও তাকে প্রাতিস্বিক কবি হিসেবে বরণ করে নেয়ার উদযাপনটি ছিল একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
কবি কামাল চৌধুরীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে বলতে চাই, বাংলাদেশের প্রশাসনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেও তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন কবি হিসেবেই, আমলা হিসেবে নন। অনেকেই উপর-চালাকি করে তাকে আমলা-কবি হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিতে আমার কাছে মোটেই তা মনে হয় না। নোবেলজয়ী জগৎখ্যাত কবি পাবলো নেরুদাকে আমরা কবি হিসেবেই চিনি, রাজনীতিবিদ বা কূটনীতিক হিসেবে নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কবি কামাল চৌধুরীকেও আমরা সেভাবেই চিনি। তিনি তরুণ বয়স থেকেই কবিতা-নিমজ্জিত এক অন্তঃপ্রাণ সত্তা। তারপর ধীরে ধীরে নিজের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবনপ্রবাহের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় যে সকল অমীয় টেক্সট, উচ্চারণ ও প্রতিলিপি সৃষ্টি করেছেন, তাতে করে তিনি এ সব জাগতিক পরিচয়ের অনেক উর্ধ্বে পৌঁছে গেছেন।
(“আমাদের কালের গোঁ ও অন্যান্য” বই থেকে)